কর্মজীবী নারীদের গণপরিবহণ সমস্যা প্রকট

1381

ঢাকা, ২৩ মার্চ, ২০২১ (বাসস) : দুই সন্তানের জননী আঁখি আক্তার চাকরি করেন গুলশানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বেতন পান মাসে ৩৫ হাজার টাকা। থাকেন লালবাগে। কারণ, দুই বাচ্চার স্কুল লালবাগে। অফিসে যাওয়া-আসার জন্য গণপরিবহনই ভরসা। বাসা থেকে আজিমপুর বাসস্টান্ডে আসেন পায়ে হেঁটে। কিন্তু প্রায় সময়ই বাস পান না তিনি। পেলেও উঠতে পারেন না যে কারণে প্রায় দিনই অফিস পৌঁছতে দেরী হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে সিএনজি চালিত অটোরিকশা অথবা অ্যাপস ভিত্তিক মোটর যান ব্যবহার করতে হয় তাকে। অফিস থেকে ফেরার সময়ও একই দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাকে।
একটি বীমা কোম্পানিত চাকরি করেন ৩৩ বছর বয়সী রোকসানা। সপরিবারে থাকেন মিরপুর ১২ নম্বরে। প্রায় ১০ বছর ধরে সেখান থেকে যাতায়াত করছেন মতিঝিল। তারও অফিস যাতায়াতে প্রতিদিন পোহাতে হয় নানা যন্ত্রণা। তাই তিনি চেষ্টা করেন সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে বাসা থেকে বের হতে। এই সময়টায় একটু ফাঁকা থাকে বাস। রাস্তায়ও মোটামুটি যানজট কম থাকে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে মতিঝিল পৌঁছানোর পর। কারণ, অফিস শুরুর প্রায় এক থেকে আধা ঘন্টা আগে পৌঁছে যান তিনি। এসময় তিনি অফিসের নিচেই বসে থাকেন।
শুধু আঁখি কিংবা রোকসানা নয়। অধিকাংশ চাকরিজীবী নারীকেই প্রতিনিয়ত পোহাতে হচ্ছে এ দুর্ভোগ। বিশেষ করে অফিস টাইমে এবং অফিস শেষ হওয়ার পর এ দুর্ভোগ বেড়ে যায় কয়েক গুণ।
আঁখি বলেন, প্রায় দিনই আমি বাসে উঠতে পারি না। প্রচন্ড ভিড় থাকে। আর অটোরিকশা বা মোটরসাইকেলে যেতে গেলে অনেক টাকা খরচ হয়। যা বেতন পাই তার অর্ধেকই চলে যায় এই যাতায়াতে।
তিনি বলেন, আবার মোটর সাইকেলে উঠতে ভয় লাগে। কারণ, প্রায় সময়ই তারা জোরে চালায়। যার কারণে অটোরিকশাই ভরসা।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মতে কর্মজীবী নারীদের ভোগান্তি আর হয়রানি অন্যদের তুলনায় বেশি। চালকের লাইসেন্স না থাকা, গাড়ির ফিটনেস না থাকাসহ নানা কারণে সা¤প্রতিক সময়ে গণপরিবহনের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। ফলে চলাচলে নারীদের দুর্ভোগের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। বাধ্য হয়ে কর্মজীবী নারীদের অটোরিকশায় চলতে গিয়ে গুণতে হয়েছে বাড়তি টাকা। অথবা অনেক সময় দাঁড়িয়ে ঠেলাঠেলি করে কোনোমতে গণপরিবহনে উঠতে হচ্ছে।
রোকসানা বলেন, যে কোম্পানিতে আছি সেখানে খুব বেশি বেতন পাই না। তাই প্রায় সময় আমি ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে যাই। কারণ, প্রতিদিন যদি আমি সিএনজি চালিত অটোরিকশা বা অ্যাপসভিত্তিক যানবাহন ব্যবহার করি তবে বেতনের প্রায় পুরোটাই চলে যাবে যাতায়াতে। যেদিন বাসা থেকে বের হতে দেরী হয় সেদিন অনেক কষ্টে গাড়িতে উঠতে হয়। এজন্য অনেকবার অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিরও সম্মুখীন হতে হয়েছে। কারণ প্রায় সময়ই বসার কোন সিট পাইনা। মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট আসনগুলোতেও পুরুষরা বসে থাকে। হেলপার তাদের উঠে মহিলাদের আসন ছেড়ে দিতে বললেও উঠে না। আবার উল্টো ঝগড়া লাগিয়ে দেয়। যার ফলে দাঁড়িয়েই যেতে হয়।
কর্মজীবী আরেক নারী কামরুন নাহার অভিযোগ করেন, দেশের বড় শহরগুলোতে বিশেষ করে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে নারী কর্মজীবীর সংখ্যা দিন-দিন বাড়ছে। কিন্তু সে তুলনায় গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ছে না। আর যেসব আছে সেসব পরিবহনে সকাল বেলা এবং বিকেল পাঁচটার পর উঠতে যাওয়া মানে যুদ্ধ করা। অধিকাংশ নারীই তখন বাসে উঠতে পারেন না। আমি নিজেও প্রায় সময় অফিস থেকে আড়াই কিলোমিটার হেঁটে বাসায় আসি। এছাড়া রয়েছে অনাকাঙ্খিত ঘটনা। কোনভাবে বাসে উঠতে পারলেও সিট পাওয়া তো দূরের কথা ভালোভাবে দাঁড়ানো পর্যন্ত যায় না।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক বলেন, গণ পরিবহনের দুর্ভোগ দিন দিন বেড়ে চলেছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে এই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তবে নারীদের ভোগান্তি একটু বেশি।
তিনি বলেন, আমার জানা মতে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম শহরে ১৯টি বাস চলে নারীদের জন্য। এসব গণপরিবহন চলে সরকারি ব্যবস্থাপনায়। এছাড়াও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে দোলন চাঁপা নামে আর একটি বাস চলে নগরীর মিরপুর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত। কিন্তু কর্মজীবী নারীর তুলনায় এসব গণপরিবহনের সংখ্যা একেবারেই কম।
তিনি বলেন, ফিটসেনবিহীন গাড়ি এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকাসহ বিভিন্ন অনিয়মের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হওয়ায় রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও কম। তবে আশার কথা হচ্ছে সরকার যাত্রীদের বিশেষ করে নারীদের যানবাহনের ভোগান্তি কমাতে আরো বেশ কিছু বাস নামিয়েছে এবং আরো কিছু নামানোর অপেক্ষায় আছে।