বয়ঃসন্ধিকালের স্বাস্থ্য নিয়ে কিশোরীদের সচেতনতা বেড়েছে

771

ঢাকা, ১৮ মার্চ, ২০২১ (বাসস) : প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে বাংলাদেশের নারীদের মাঝে সচেতনতা বেড়েছে। শুধু শহরাঞ্চলেই নয়, প্রত্যন্ত গ্রামেও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বেড়েছে এ সংক্রান্ত স্বাস্থ্য সচেতনতা। এখন অনেক কিশোরীই সংকোচ বাদ দিয়ে স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী কিংবা ফার্মেসি থেকে স্যানেটারি ন্যাপকিনসহ তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার দেশজুড়ে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে চিকিৎসাসেবা। নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতার ফলে এখন মা ও শিশুর মৃত্যু হারও কমেছে। বেড়েছে গড় আয়ু।
‘বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপ ২০১৬: প্রাথমিক প্রতিবেদন’ অনুযায়ী,
প্রজননক্ষম বয়সে অর্থাৎ ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সে নারীদের যে মৃত্যু হচ্ছে, তার ১৩ শতাংশই ঘটছে সন্তান জন্ম দেয়ার সময়। মায়েদের প্রতি অবহেলা ও অবজ্ঞার কারণেই এ মৃত্যু ঘটছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। যদিও এই হার নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও নিপোর্ট এর পাল্টাপাল্টি বক্তব্য রয়েছে।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০০১ ও ২০১০ সালে মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপ প্রকাশ করা হয়। ২০০১ সালের জরিপে বলা হয়েছিল, ২০ শতাংশ নারীর মৃত্যুর কারণ মাতৃত্বসংক্রান্ত। অর্থাৎ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে এই সংখ্যক মায়ের মৃত্যু হয়েছে।
২০১০ সালে তা কমে ১৪ শতাংশে দাঁড়ায়। ছয় বছরের ব্যবধানে তা হয় ১৩ শতাংশ। ২০ থেকে ৩৪ বছর বয়সী নারীরা বেশি মারা যাচ্ছেন মাতৃত্বকালীন জটিলতায়।
বিশ্ব জনসংখ্যা প্রতিবেদন (২০১৫) হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের ৪৭.৬ মিলিয়ন বা শতকরা ৩০ শতাংশ জনসংখ্যা ১০-২৪ বছর বয়সি কিশোর ও তরুণ। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, বিদ্যালয়ে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষার অভাব এবং মা-বাবা, আত্মীয়-স্ব^জন ও শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা না পাওয়ার কারণেই তারা ভুল জানে, ভুল কথা বিশ্বাস করে এমনকি সঠিক তথ্য না জানার কারণেই কখনও কখনও খারাপ লোকেদের পাল্লায় পড়ে যায়। ফলে হারিয়ে যায় তাদের জীবনের ছন্দ।
কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে কাজ করা ব্র্যাকের একটি প্রকল্পের কর্মকর্তা শাহীন আহমেদ বলেন, কৈশোরে ছেলে-মেয়েদের মাঝে হঠাৎই পরিবর্তন আসে। বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন নিয়ে তাই প্রত্যেক কিশোর-কিশোরীর স্বচ্ছ ধারণা থাকা জরুরি।
সম্প্রতি ব্র্যাক আয়োজিত এসআরএইচআর বিষয়ক এক কর্মশালায় কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, ‘প্রতিটি পরিবার যদি মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালে সবাইকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষা দেয়, তাহলে সারা দেশে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের জায়গা তৈরি করা সম্ভব।’
জানা যায়, বয়ঃসন্ধিকালের বিষয়টি মাথায় রেখেই কিশোরীদের কল্যাণে সরকার স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র (এএফএইচসি) চালু করেছে। এছাড়া বিভিন্ন এনজিওর স্বাস্থ্যকর্মীরা দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য প্রোগ্রামের মাধ্যমে তথ্যপ্রদান, কাউন্সেলিং এবং কর্মশালার উদ্যোগ নিয়েছে । এজন্য কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ এবং নিয়মিত স্কুল পরিদর্শন আরও গুরুত্বপূর্ণ।
এ প্রসঙ্গে ইউএসএআইডি’র জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সামিনা চৌধুরী বলেন, প্রজনন স্বাস্থ্য বলতে সাধারণত প্রজননের সঙ্গে অঙ্গগুলোর স্বাস্থ্যকে বুঝি। কিন্তু আমরা এভাবে যদি বলি তাহলে বিষয়টি খুব সংক্ষিপ্ত আকারে দেখা হয়। আসলে প্রজনন স্বাস্থ্য আমাদের সামগ্রিক সুস্থতার সঙ্গে জড়িত। কারণ প্রজনন স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে সার্বিকভাবে সুস্থ থাকা যায় না। অথচ আমাদের এখানে প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে স্পষ্ট বোধ নেই। বরং এটি নিয়ে লুকোচুরি এবং চাপাচাপি থাকাতে কিছুটা অজ্ঞতা থেকে যায়। এই অজ্ঞতা থেকে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়।
প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা মনে করি যখন কিশোর-কিশোরীরা পূর্ণ বয়স্ক মানুষ বা তরুণ-তরুণী হয়, তখনই হয়তো প্রজনন স্বাস্থ্যের যতœ নিতে হয়। ব্যাপারটি মোটেও তা নয়। শৈশব থেকেই প্রজনন স্বাস্থ্যের যতœœ নিতে হয়। কারণ একটি শিশু যদি পুষ্টি ঠিকমতো না পায় তাহলে তার প্রজনন অঙ্গগুলো ঠিকমতো বেড়ে উঠবে না।
সবাইকে সচেতন করার জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ থাকলেও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে এখনও খোলামেলা আলোচনার পরিবেশ তৈরি হয়নি। বয়োঃসন্ধিকাল থেকে শুরু করে নারীদের ক্ষেত্রে মেনোপজ হওয়া আর পুরুষের ক্ষেত্রে প্রজননে শারীরিক সক্ষমতা পর্যন্ত সেবা কার্যক্রম বাংলাদেশের সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবার মধ্যেই রয়েছে। অথচ সঠিক তথ্য না জানার কারণে বেশিরভাগ মানুষ প্রজননস্বাস্থ্য সেবা নিতে আগ্রহী হচ্ছে না। তবে সার্বিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি সূত্র বলছে, দৈনিক প্রায় ১৬ নারী বা প্রতিবছর ৫ থেকে ৬ হাজার মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন, যার ৯৫ শতাংশই প্রতিরোধযোগ্য। তাই এই মৃত্যু কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধীনে মিডওয়াইফারি এডুকেশন বিষয়ে কোর্স চালু রয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার চিত্র তুলে ধরে এ প্রোগ্রামের প্রধান সেলিনা আমীন বলেন, মিডওয়াইফ সেবাকে গুরুত্বারোপের মাধ্যমে মায়ের মৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে কমানো সম্ভব।