বাসস দেশ-৩৩ : উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে নারীর সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ

826

বাসস দেশ-৩৩
নারী-ক্ষমতায়ন
উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে নারীর সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ
॥ মাহফুজা জেসমিন ॥
ঢাকা, ৭ মার্চ, ২০২১ (বাসস): নারী আন্দোলনের নেত্রী, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার ও উন্নয়ন কর্মীরা দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে নারীর সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করছেন।
বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নারীর ক্ষমতায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে কাজ করছে। গত প্রায় দুই দশকে নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে যে মাইলফলক সূচিত হয়েছে তা বাংলাদেশকে বিশ্বে এক অনন্য মাত্রায় পরিচিতি দিয়েছে। তাই বলে, নারীর চিরায়ত যুদ্ধ কিন্তু থেমে যায়নি। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন যুদ্ধ ক্ষেত্রও। আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ষাটের দশকের নারী আন্দোলনের নেত্রী বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফৌজিয়া মোসলেম, আইন ও শালিস কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক জেন্ডার বিশেষজ্ঞ শীপা হাফিজা এবং ব্র্যাক এর জেন্ডার, জাস্টিস ও ডাইভারসিটি প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম হেড সেলিনা আহমেদ।
ড. ফৌজিয়া মোসলেম বাসসে’র সাথে আলাপকালে বলেন, বাংলাদেশে উন্নয়নের একটি বড় জায়গা হচ্ছে সামাজিক সূচকে আমাদের অর্জন। সামাজিক সূচকের এই অর্জনগুলো কিন্তু নারীকে কেন্দ্র করেই হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় নারীদের শতভাগ নিবন্ধনের সাফল্যও তিন বছর আগেই আমরা অর্জন করেছি। মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীর অবস্থান ও অংশগ্রহণ আমাদের সামাজিক সূচককে সামনের দিকে এগিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু, উন্নয়নের মূল ধারায় নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন নারী আন্দোলন এই নেত্রী। তিনি বলেন, উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে জেন্ডার ইকুয়ালিটির যে ধারণা, সেই ধারনাটা সমাজে আরেকটু বাড়ানো দরকার। কারণ, জেন্ডার ইকুয়ালিটি যদি সমাজ না বোঝে তাহলে সমাজ আগাবে না। সমাজ বলতে আসলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বুঝতে হবে। সরকারকেও বুঝতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়েও এর চর্চ্চা করতে হবে।
আইন ও শালিস কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং জেন্ডার বিশেষজ্ঞ শীপা হাফিজা নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তৃৃণমূলের নারীদের সরাসরি ভোটে অংশগ্রহণকে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
তিনি বলেন, যখন থেকে স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদে নারীরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসছেন তখন থেকেই কিন্তু বাংলাদেশের উন্নয়নেরও পদচারণা আমরা হতে দেখেছি। পাশাপাশি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) গুলো নারীদের এগিয়ে নিয়ে যেতে যে কাজ করেছে সেটি নারীকে সাহসী এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অগ্রণী করে তুলেছে। একারণেই, শিক্ষা, ব্যবসা ও রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীর যে বিচরণ সেটা ধাপে ধাপে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যু হারের নিম্ন গতির মধ্যেও আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাই। এছাড়া, মাইক্রোফাইন্যান্স-এ অতি দরিদ্র নারীর অর্থনৈতিক প্রবেশগম্যতাও আমাদের দেশে দারিদ্র্য বিমোচনের একটি বড় অধ্যায় তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, শস্য উৎপাদন, পশু পালন ও পশু সম্পদ উন্নয়নেও নারী অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করছে। এমনকি পরিবেশের কারণে যে কঠিনতর সমস্যাগুলো হচ্ছে, সেখানেও কিন্তু নারীরা এখনো টিকে আছে এবং সেটাকে ধরে রেখেছে।
সেলিনা আহমেদ মনে করেন, দারিদ্র্য কমাতে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যেসব কাজ হচ্ছে, সার্বিকভাবেই বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রেও তা ভূমিকা রাখছে।
সেলিনা আহমেদ বলেন, তৈরি পোশাক শিল্পের বৃহত্তর পরিসরে নারীরা যেভাবে ভূমিকা রাখছে তা জিডিপিতে নারীর অবদানকে নির্দেশ করে। কৃষি ক্ষেত্রে বা ইনফরমাল সেক্টরেও নারীরা কাজ করছে। এসবই আসলে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়ার একটি অংশ। এভাবেই নারীর ক্ষমতায়নের মধ্যে দিয়েই সামাজিক পরিবর্তন এসেছে।
তবে, উন্নয়নের এই ধারাবাহকতা বজায় রাখতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সমাজে নারী-পুরুষের সমতার অবস্থান। উন্নয়নের মূল ধারায় নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেলেও নারীর প্রতি সহিংসতার মনোভাব থেকে সমাজকে বের করে আনতে না পারলে প্রকৃত ক্ষমতায়ন যেমন হবে না তেমনি উন্নয়নের ধারাবাহিকতাও থমকে যাবে।
ড. ফৌজিয়া মোসলেম বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়, রাজনৈতিক নেতৃত্বে এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্র নারীদের জন্য অনেক সুযোগ সৃষ্টি করেছে, কিন্তু রাষ্ট্রের যে অবকাঠামো সেখানে নারীদের নেতৃত্ব দিতে বাধা দিচ্ছে। সেই সব বাধা দূর করে সুযোগগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে।
শীপা হাফিজা বলেন, আমাদের রাষ্ট্র যখনই একটি উন্নয়নের পদসোপানে এগিয়ে গেছে তখনই যেমন বিভিন্ন রকম সম্মাননা আমরা পেয়েছি। রাষ্ট্রের উন্নয়নের যে স্বীকৃতিগুলো পেয়েছি সেখানেও রয়েছে নারীর অবদান। কিন্ত পাশাপাশি আমরা দেখেছি যে নারী এবং পুরুষের পথ চলার মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা আছে। আমাদের এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ এই প্রতিযোগিতায় মুলত নারীর প্রতি নির্যাতন, ধর্ষণ ও সহিংসতাকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে।
ক্ষমতায়নের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে আরো কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান তিনি । তিনি বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা দমন করতে না পারলে আসলেই দেশটা বেশি এগুতে পারবে না।
তিনি উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে, নারীর ইচ্ছা আকাক্সক্ষা এবং মর্যাদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের সমস্ত কৌশল, নীতিমালা ও আইনসমূহ সংশোধন করে তা যথাযথ বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন।
দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় এখনো পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব নারীর ক্ষমতায়নকে পিছিয়ে দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতীয়ভাবে নারীর ক্ষমতায়ন তথা দেশের সার্বিক উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে হলে প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর ইচ্ছা, নারীর পছন্দ , নারীর ভয়েস এবং নারীর মর্যাদাকে প্রাধান্য দিতে হবে। নারীকে কেন্দ্রে না রাখলে এখনকার এই নতুন পৃথিবীতে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে।
নারীর ওপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়ায় নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে বলে মনে করেন সেলিনা আহমেদ। তিনি বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়লেও নারীরা সাইলেন্স ব্রেক করছে। পুরুষের নিয়ন্ত্রণ থেকে নারী বের হয়ে আসতে চাইছে বলেই পারিবারিক ও সামাজিক সংঘাত তৈরি হচ্ছে। তবে, নারীরা নিয়ন্ত্রণ ভেঙ্গে ক্রমান্বয়ে বের হয়ে আসছে এটাও কিন্তু উন্নয়নের অংশ। ক্ষমতায়নের একটা সূচক।
তিনি বলেন, নারীর সামাজিক ক্ষমতায়নের পাশাপাশি তার জন্য সুরক্ষা বলয় তৈরি করতে হবে। না হলে, সহিংসতা দিনের পর দিন বাড়বে। আমরা যদি নারীর জন্য সেই সুরক্ষা বলয়টা তৈরি না করতে পারি তাহলে বাধাগুলো আসবেই। নারীরা ঘরের বাইরে বের হবে। বাধার সাথে লড়াই করেই এগুবে। কিন্তু, এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সবারই কাজ করার আছে।
বাসস/বিপ্র/এমজে/১৮১৮/আরজি