পাবলিক টয়লেট সমস্যা নারীদের

854

॥ মৌসুমী ইসমাত আরা ॥
ঢাকা, ২০ আগস্ট, ২০১৮ (বাসস) : স্কুলগুলোতে এসএসসি পরীক্ষা চলছে। স্কুলের চারপাশে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এ রকমই একটি স্কুলের কাছাকাছি রাস্তার পাশে বসে আছেন মায়েরা। কেউ কেউ খবরের কাগজ, আবার কেউ কেউ বিছানার চাদর নিয়ে এসেছেন সাথে, তা বিছিয়ে বসেছেন। এখন ঘর থেকে বাইরে বের হলেই পানির বোতল, ছাতা আর নাস্তার বক্স মহিলাদের অনুষঙ্গ। অনেকে আবার একটু ছায়ার আশায় কাছাকাছি আবাসিক এলাকার বহুতল ভবনগুলোর ফটকের পাশে গিয়ে বসেছেন। তিন ঘন্টার পরীক্ষা। আসতে হয়েছে হাতে একটু সময় নিয়েই। যানজট এখানে নিত্যনৈমিত্তিক, তাই পরীক্ষার সময় কোন অভিভাবকই ঝুঁকি নিয়ে চান না। তাই বাসা থেকে একটু আগেই বের হতে হয়। আবার পরীক্ষা শেষে ছাত্র-ছাত্রীদের হল থেকে বের হতেও আধ ঘন্টা সময় লেগে যায়। তারপর বাড়ি ফেরা। সবমিলিয়ে ৬/৭ ঘন্টার ধাক্কা। এই পুরোটা সময় বাথরুমে না গিয়ে থাকাটা একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। অপেক্ষমান মায়েদের অনেকেই রীতিমত বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এটি স্কুলগুলোর সামনে অপেক্ষমাণ নারীদের টয়লেট সমস্যার নৈমিত্তিক চিত্র।
এটি কেবল সমস্যাই না একই সঙ্গে বিড়ম্বনাও। তাহলে এখানে স্কুল কর্তৃপক্ষ এসব দেখেও দেখেন না। আর পাবলিক টয়লেট তো আশেপাশে নেই বললেই চলে।
পাবলিক টয়লেটের সমস্যাটি কোনভাবেই নতুন নয়, অনেক পুরনো একটি বিষয়। ২০১৭ সালের এক সমীক্ষায় জানা যায়, ঢাকায় ৫০ লাখ পথচারীর জন্য টয়লেট আছে মাত্র ৪৭টি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যবহারের অযোগ্য। কতগুলো আবার বন্ধ থাকে। যেগুলো চালু আছে সেগুলোতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বলতে কিছু নেই। প্রায় পৌনে দুই কোটি ঢাকাবাসীর মধ্যে প্রায় অর্ধেক নারী হলেও তাদের জন্য পৃথক কোনো টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। টয়লেটের অভাবে ঢাকার অলিতে-গলিতে মানুষ প্র¯্রাব পায়খানা করে থাকে। এতে করে পরিবেশের মারাত্মক দূষণ হচ্ছে। টয়লেট নিয়ে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের শেষ নেই।
ডিএসসিসির একজন কর্মকর্তা জানান, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উন্নতমানের বেশ কয়েকটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে কয়েকটি চালুও হয়ে গেছে। বাকিগুলোর কাজ শেষ হলে টয়লেট সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যাবে।
অনেক হোটেল-রেস্তোরাঁয় বাথরুমের ব্যবস্থা থাকে না। আবার মহিলাদের পক্ষে সবসময় দূরে দূরে যাওয়াও সম্ভব নয়। ছয়-সাত ঘন্টা সময় কিন্তু বেশ দীর্ঘ একটি সময়। অভিভাবকরা কেউই নিশ্চিন্তে কোথাও বসতে পারেন না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দীর্ঘসময় টয়লেটে না গেলে রোগ সংক্রমণ হতে পারে এবং ইউরিন ইনফেকশন ও কিডনি রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। মহিলাদের অনেককেই বয়স অথবা শারীরিক সমস্যার কারণে পড়তে হয় অস্বস্তি আর লজ্জার মুখে। তাই অনেক সময় অনেক নারীকে ভবন মালিকদের কাছে অনুনয়-বিনয় করতে হয় তাদের ওয়াশরুম ব্যবহারের জন্য।
অনেক বয়স্ক মহিলা অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে ডায়াপার ব্যবহার করে। কিন্তু এই সমস্যা হাতে গোণা। ডায়াপার সহজলভ্য পণ্য নয় সবার জন্য, আবার এ দেশের মহিলারা এটি ব্যবহারে একেবারেই অভ্যস্ত নয়। শয্যাশায়ী রোগীরা অনেকেই এখন ডায়াপার ব্যবহারে কিছুটা অভ্যস্ত হয়েছেন। কিন্তু অবশ্যই ডায়াপার পাবলিক টয়লেটের কোন বিকল্প নয়। পরিচ্ছন্নতার জন্য পানির ব্যবহার এ দেশের অরিহার্য ।
যেখানে গণসমাবেশের প্রয়োজন থাকে, সেসব স্থানে, বিশেষ করে মহিলাদের জন্য পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা করা জরুরি।
ফার্মগেটে এক বিকেলে ঘরমুখী মানুষের প্রচন্ড ভিড়। বাসগুলোও থামার কোন চেষ্টা না করেই শাঁ করে ছুটে চলে যাচ্ছে গন্তব্যের দিকে। একটি দুটি লেগুনা যাত্রী নিয়ে আসছে, কিন্তু ভেতর থেকে যাত্রীরা ফার্মগেটে নামার আগেই তাতে লাফিয়ে উঠে পড়ছে। ভিড়ের মধ্যে বিভিন্ন বাসের মহিলা যাত্রীও অনেক। নিরূপায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। অনেকেই এক ঘন্টার বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। এর মধ্যে একজন বয়স্ক নারীকে একটু এগিয়ে গিয়ে ইন্দিরা রোডের এক ভবনের দারোয়ানকে অনুরোধ করলেন তাকে একটু ওয়াশরুম ব্যবহারের অনুমতি দিতে। দারোয়ান টেলিফোনে কারো অনুমতি নিয়ে মহিলাকে তাদের জন্য নির্দিষ্ট বাথরুমে নিয়ে গেলেন। দেখাদেখি আরো কয়েকজন মহিলাও এই সুযোগটুকু নিলেন। অপরিচিত কাউকে সবসময় অনুমতি দেয়া সম্ভব হয় না বাড়ির দারোয়ানের পক্ষে। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যার সমাধান হতে পারে এসব জায়গায় যথোপোযুক্ত পাবলিক টয়লেট স্থাপন।
পহেলা ফাল্গুনের উৎসব অথবা পহেলা বৈশাখের বিশাল আয়োজন হাজার হাজার মানুষ খোলা জায়গায় অংশ নেন। সেখানেও নারী ও শিশুদের দুর্ভোগের শেষ থাকে না। এমন অনেকেই আছেন, যাদের বয়স একটু বেশির দিকে, ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে এবং এসব উৎসবে গাড়ি অনেক দূরে রেখে অনেকখানি পথ হেঁটে যেতে হয় অনুষ্ঠানস্থলে। এসব কারণে তারা এখন ইচ্ছে থাকলেও উৎসবে অংশ নিতে পারেন না। এ সমস্যা সমাধানে সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকায় অনেকেই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এসব বিনোদোনে অংশ নিতে চান না। সমস্যাগুলোর সাথে মানসম্মানের বিষয়টিও জড়িত। সেখানে আয়োজকরা ওপেন প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করেন, সেখানে অবশ্যই পাবলিক টয়লেট বড় একটা চোখে পড়ে না।
কিছুদিন আগে রাজধানীর একটি রাজনৈতিক সমাবেশে দূর থেকে আসা নারী কর্মীদের এই বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়। সমাবেশস্থলের কাছে বেশ কয়েকটি মোবাইল টয়লেট ছিল। কিন্তু এই মোবাইল টয়লেটগুলোর ব্যবস্থাপনা ভালো ছিলো না। চার চাকার বিকশা ভ্যানের ওপরে স্থাপিত মোবাইল টয়লেটগুলোর উচ্চতা একটি বড় রকমের ঝামেলার বিষয় এবং সেখানে ওঠার জন্য ছিল একটি উঁচু প্লাস্টিকের টুল। টুলে পা রেখে সরাসরি ঢুকে পড়তে হয় টয়লেটের ভেতরে। পুরো বিষয়টি অস্বস্তিকর।
গুলিস্তানে এবং ফার্মগেটে স্থায়ী টয়লেট রয়েছে কিন্তু সবাই এগুলোর খবর জানেন না। আরো বেশ কয়েকটি জায়গায় স্থায়ী ওয়াশরুম থাকলেও সেগুলো ব্যবহার উপযোগী নয়। কোনটার দরজা-জানালা সব ভাঙ্গা, কোনটায় পানির ব্যবস্থা নেই, কোনটায় আবর্জনা স্তূপ হয়ে আছে। স্থায়ী ওয়াশরুমগুলোতে জায়গা করে নিয়েছে ছিন্নমূল ভবঘুরে মানুষ আর নেশাখোরদের একটি দল। মহিলাদের অনেকেই, বিশেষ করে যারা জানেন, সেখানে বাথরুম আছে, তারা নেশাখোরদের উপদ্রবের ভয়ে যেতে চান না।
এসব সমস্যার ভালো সমাধান হচ্ছে নাÑ এটা দুর্ভাগ্যজনক। মোবাইল টয়লেটগুলো কেমন হলে তা সবাই ব্যবহার করতে পারবেন এবং স্থায়ী টয়লেটের সংখ্যা আরো বাড়ানো ও এগুলোর সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যক্তিপর্যায়ে আগ্রহীদের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। এতে করে সর্বস্তরের মানুষের বিশেষ করে নারী ও শিশুদের দুর্ভোগ কমবে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় যেমন মোবাইল টয়লেট থাকতে পারে, সেভাবে জেলা শহরগুলোতেও একই ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। রেলস্টেশনে ও বাস স্ট্যান্ডগুলোর টয়ালেটগুলোকে পরিচ্ছন্ন ও ব্যববহার উপযোগী রাখার জন্য প্রয়োজন কেবল একটু সজাগ দৃষ্টি।
এসব টয়লেট যাতে প্রয়োজনে ছিণœমূল মানুষও ব্যবহার করতে পারেন, সেজন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকতে পারে। টয়লেট ব্যবহারের বিনিময়ে অর্থের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। যারা মোবাইল টয়লেট চালুর উদ্যোগ নেবেন বা নিচ্ছেন, তারা যেন অতিরিক্ত অর্থ আদায় না করেন তার সুষ্ঠু তত্ত্বাবধান থাকতে হবে। আর এতে করেই গড়ে উঠতে পারে একটি পরিচ্ছন্ন এলাকা, পরিচ্ছন্ন দেশ।
পাবলিক টয়লেট পরিচ্ছন্ন ও তাতে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা থাকলে তা একদিকে যেমন সুস্থ জীবনের নিশ্চয়তা দেবে, অন্যদিকে পবিত্রতাও নিশ্চিত হবে। সর্বোপরি মা-বোনেরা রেহাই পাবেন অবশ্যম্ভাবী বিড়ম্বনার হাত থেকে। তাই সুস্থ নাগরিকের সুস্থ জীবন ব্যবস্থা গড়ে তোলা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।