প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবাই নবজাতকের মৃত্যু রোধ করতে পারে

341

ঢাকা, ২ মার্চ, ২০২১ (বাসস) : সায়মা আক্তার (২৮) গর্ভকালীন সময়ে ঠিকভাবে নিয়ম মেনে চলেছেন, চিকিৎসকের মাধ্যমে চেকআপও করিয়েছেন। গর্ভকালীন সময়ে ভালো থাকায় প্রসবের সময় বাড়িতে ছিলেন এবং অভিজ্ঞ নার্সের মাধ্যমে প্রসব করিয়েছেন। কিন্তÍ প্রসবের সময় প্রসব পথে শিশুটি বেশ কিছুক্ষণ আটকে ছিল। তাই জন্মের পর শিশুটি খানিকটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং তার শ^াসকষ্ট দেখা দেয়।
সায়মা শিশুটিকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক বলেন, ‘প্রসবের সময় শিশুটি বেশি সময় ধরে প্রসব পথে আটকে থাকায় তার শ^াসকষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থায় তার বিশেষ যতœ ও চিকিৎসা প্রয়োজন। নতুবা তাকে বাঁচানো যাবেনা।’
প্রসবকালীন জটিলতা এড়াতে সরকার শহর-গ্রাম এমনকি থানা পর্যায়ে বিভিন্ন হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করেছে এবং সেখানে মাতৃস্বাস্থ্য ও প্রসবের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও সুবিধা রয়েছে। এরপরও মানুষ প্রসবের সময় বাড়িতে প্রসব করাচ্ছেন এটা ঠিক নয় বলে জানালেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘মাতৃস্বাস্থ্য কর্মসূচি’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আজিজুল আলীম।
চিকিৎসকরা বলছেন, সাধারণত শিশুর জন্মের সময় থেকে ২৮তম দিন পর্যন্ত একটি শিশুকে নবজাতক হিসেবে ধরা হয়। কী কী কারণে নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি থাকতে পারে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যাপক ডা. আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘অনেক কারণে নবজাতকের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে তিনটি কারণ অন্যতম। এক. যে কোনো সংক্রমণ দুই. শ^াসকষ্ট এবং তিন. ডায়রিয়া। মায়ের বয়স কম হলেও নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি থেকে যায়। কিশোরী মা’র শরীরের গঠন তখনও ঠিকভাবে হয়না। সে শিশুর সমস্যাগুলো বুঝতে পারে না এবং যতœও নিতে পারেনা। গর্ভকালীন সময়ে মাকে সচেতন থাকতে হয়। ওই সময় আয়রন, ক্যালসিয়াম ও ফলিক এসিড খেতে হয়। দুপুরে দুই ঘণ্টা এবং রাতে দশ ঘণ্টা বিশ্রাম ও ঘুম প্রয়োজন। অনেকেই এসব নিয়ম মেনে চলেন না। অনেকের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, রক্তস্বল্পতা ইত্যাদি থাকে। এসব অসুখ থাকলে প্রসবকালীন জটিলতা দেখা দেয় এবং নবজাতকের সমস্যা হতে পারে।’
কীভাবে এই মৃত্যুঝুঁকি কমানো যায় জানতে চাইলে ‘বাংলাদেশ ইউনেটাল ফোরাম’-এর সভাপতি ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. তাহমিনা বেগম বলেন, ‘অনেকগুলো কারণে নবজাতকের মৃত্যু হতে পারে। এটা যাতে না হয় সেজন্য মায়ের গর্ভকালীন যতœ এবং গর্ভকালীন চেকআপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের যদি অ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের সমস্যা ইত্যাদি থাকে তাহলে তাকে চিকিৎসা নিতে হবে। নবজাতক কম ওজন নিয়ে জন্মালে এবং যদি প্রিম্যাচিউর বা অপরিণত অবস্থায় জন্মায় তাহলে তাকে গরম রাখার জন্য ইনকিউবেটরে রাখতে হবে। ইনকিউবেটরে রাখা সম্ভব না হলে চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে তাকে কী উপায়ে রাখলে সে গরম থাকবে। প্রসবকালীন বাধা বা জটিলতার জন্যও নবজাতকের শ^াস নিতে কষ্ট হয়। এরকম হলে বা নবজাতক যে কোনো উচ্চ ঝুঁকি নিয়ে জন্মালে তার দিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণত শ^াসকষ্ট, ডায়রিয়া বা কোনো সংক্রমণ হলে নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়াও নিমোনিয়া, জন্ডিস হলেও নবজাতক মারা যেতে পারে। নবজাতকের সংক্রমণ রোধের জন্য নাভি কাটার নির্ধারিত কিট রয়েছে। সেগুলো ব্যবহার করতে হবে। শিশুকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রাখা বা পরানো দরকার। এছাড়া নবজাতককে কোলে নেয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত পরিস্কার করে নিতে হবে। এভাবে চললে সংক্রমণ অনেকটা এড়ানো সম্ভব। অবশ্যই নবজাতককে জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে শাল দুধ খাওয়াতে হবে এবং নিয়ম অনুযায়ী মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। মায়ের দুধই পারে শিশুর নানা সমস্যা রুখে দিতে।’
সেভ দ্যা চিলড্রেন, বাংলাদেশ-এর এসএনএমপি এবং অতিরিক্ত দায়িত্ব আইএনএসপি প্রোগ্রামের সিনিয়র ম্যানেজার ডা. মোশতাক আহমদ বলেন, ‘নবজাতকের মৃত্যুরোধ করতে সারা বিশ^ যেভাবে কাজ করছে আমরাও সরকারের সাথে মিলে সেইসব বিষয় নিয়ে কাজ করছি। আগে নবজাতকের নাভিতে সিঁদুর, গোবর বা বিভিন্ন বস্তু দেয়া হতো। এতে খারাপ ফল হতো। কিন্তÍু এখন আমরা নাভিতে ক্লোরোফিটো ড্রপ দেই। যাতে নাভিতে কোনো সংক্রমণ না হয় এবং নাভি ভালো থাকে। যেসব নবজাতকের ওজন কম বা যারা অপরিণতভাবে জন্মেছে তাদেরকে ‘ক্যাঙ্গারু মাদার’ সেবার আওতায় আনা হয়।”
তিনি আরো বলেন, ‘কখনো কখনো সময়ের আগেই মায়ের প্রসব ব্যথা শুরু হয়। সেক্ষেত্রে গর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় শিশুটির ফুসফুসে যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেজন্য মাকে এন্টিনেটাল স্টোরয়েট ইনজেকশন দেয়া হয়। এতে শিশুর ফুসফুস ভালো থাকে। এছাড়া অনেক নবজাতক জন্মকালীন শ^াসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। এটা যাতে না হয় সেজন্য একটা ব্যবস্থা রয়েছে সেটা আমরা সকল হাসপাতাল এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদেরও শিখিয়ে দিয়েছি। তারা এ সেবা দিতে পারে। এ ধরণের আরো নানা বিষয়ে চিকিৎসা ও সেবা দেয়ার মাধ্যমে নবজাতকদের মৃত্যুরোধ করা হচ্ছে।’
গর্ভকালীন চেকআপ, সুষম খাবার, গর্ভকালীন মায়ের রোগের চিকিৎসা, হাসপাতালে ডেলিভারী এবং প্রয়োজনীয় সচেতনতা নবজাতকদের মৃত্যুরোধে অনেক কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে বলে জানান চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট সকলে।