বাসস ইউনিসেফ ফিচার-৩ : শ্রমিকের কাজ করেও এসএসসিতে ভাল ফল করেছেন রাজশাহীর আমিন

336

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-৩
শ্রমিক-আমিন
শ্রমিকের কাজ করেও এসএসসিতে ভাল ফল করেছেন রাজশাহীর আমিন
ঢাকা, ১৫ আগস্ট, ২০১৮ (বাসস) : রাজশাহীর পুঠিয়ার নওপাড়া গ্রামের হাজেরা খাতুনের মন আনন্দে ভরে গেছে। তার ছেলে আমিন আলী এবার এসএসসিতে ভালো ফল করেছে। আর তাতেই ওর মা হাজেরা খাতুনের মন আনন্দে ভরে গেছে।
যারা এবার এসএসসিতে ভালো ফল করেছে, তাদের সবার পরিবারেই এই আনন্দ। আমিনের জন্য আলাদা কেন?
কারন স্কুলে যাওয়ার জন্য ও যে শার্টটা পরত, সেটা বানানো হয়েছিল ক্লাস সিক্সে থাকতে। সেই পোশাকেই ও পাড়ি দিয়েছে ক্লাস টেন পর্যন্ত। খুব বেশি পরা হয়নি বলে শার্টটা ছিঁড়ে যায়নি, তবে এখন গায়ে আঁটসাঁট হয়ে যায়।
ওর মা কাজ করেন চাতালে, ইটের ভাটায়। সারাদিন পরিশ্রম করে যা পান, তা দিয়েই কিছু কিনে আনেন বাজার থেকে, তারপর তাদের খিদে মেটে। বহুদিন আমিনকে স্কুলে যেতে হয়েছে না খেয়ে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে হাঁড়ি-পাতিল উল্টে দেখেছে, কিছু নেই। মা এসেছেন, রান্না করেছেন, তারপর মা-ছেলে খেয়েছে কিছু।
এভাবেই চলছে নারী শ্রমিক হাজেরা খাতুনের সংসার। তারপরও তিনি চেয়েছেন ছেলে পড়াশোনা করুক।
হতদরিদ্র বাবা অল্প বয়সেই হাজেরাকে বিয়ে দিয়েছিলেন। স্বামীর বাড়িতে গিয়ে দেখেন তার আগে তার স্বামী আরও দুটি বিয়ে করেছেন। তাদের একজন তখনো সংসারে রয়েছেন। বাবার সংসারের দৈন্যের কথা ভেবে সব মেনে নিয়ে স্বামীর সংসার শুরু করেছিলেন হাজেরা খাতুন। সংসারে প্রথম এল মেয়ে, এরপর ছেলে।
মেয়ের পরে যখন ছেলে হলো, স্বামীর প্রথম পক্ষের ছেলেমেয়েরা হাজেরা খাতুনকে আর মেনে নিতে পারেন না। ফুপুশাশুড়িসহ এই ছেলেমেয়েরা তার ওপরে অত্যাচার শুরু করেন। এক পর্যায়ে স্বামী তাকে তালাক দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন। সেই থেকে হাজেরার যুদ্ধ শুরু।
দুই সন্তান বুকে করে রাস্তায় নেমে আসেন তিনি। যাবেন কোথায়? শেষমেশ বাবার সংসারেই ফিরে আসেন। কিন্তু বাবার সংসার তো আরো দরিদ্র। বাবা মেয়ের থাকার জন্য শুধু দুই শতাংশ জমির ওপরে একটি খুপরি ঘর তুলে দেন। সে ঘরে কোনো খাবার নেই। বিভিন্ন জায়গা থেকে তার জন্য দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু কোথায় গেলে দুমুঠো খাবার জুটবে, কেউ তা বলেন না। প্রথম কয়দিন সারাদিন কোনো খাবার জোটাতে পারেন না। সেই থেকে প্রথমে অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ ও পরে মাঠের কাজ শুরু করেন।
আমিনের যখন এক বছর বয়স, ওর বোনের আড়াই, তখন এক বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন মা। মেয়েকে গৃহস্থবাড়ির বারান্দায় রেখে বাড়ির কাজ করতেন হাজেরা।
এই কষ্টে ঝিয়ের কাজ ছেড়ে দিয়ে মাঠে নামেন। হয়ে যান নারী শ্রমিক। এরপরই ধানের চাতালে, ইটের ভাটায় কাজ করতে শুরু করেন। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে করতেই দিন কেটে যায়। মেয়ে মেধাবী ছিল, কিন্তু অর্থের অভাবে ওকে বেশি দূর পড়াতে পারেননি, অষ্টম শ্রেণি পাস করার পর বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমিনকে হাল ছাড়তে দেননি।
পুঠিয়ার ধোপাপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের এই ছাত্র মা হাজেরা খাতুনকে কাজে সাহায্য করে। সপ্তাহে কয়েক দিন পুঠিয়ার নওপাড়া বাজারের ব্যবসায়ী আবদুস সামাদের দোকানে কাজ করে। ভোর থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত ট্রাক থেকে সার ও সিমেন্ট নামাতে হয়। তা ছাড়া রাতে মাছের গাড়িতে ঢাকা ও সিরাজগঞ্জে যায়। সারারাত পা দিয়ে ট্রাকে পানি নাড়তে হয় যাতে মাছ অক্সিজেন পায়, ঢাকায় যাওয়া পর্যন্ত মাছগুলো তাজা থাকে। এক ট্রাক মাছ ঢাকায় পৌঁছে দিলে ২০০ টাকা পারিশ্রমিক পাওয়া যায়। কখনো ব্যবসায়ী তার সঙ্গে ১০০ টাকা বখশিশ দিয়ে থাকেন।
হাজেরা বলেন, ‘আমাকে সাহায্য করার জন্য ছেলেটা সপ্তাহের সব দিন বিদ্যালয়ে যেতে পারেনি।’
ধোপাপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মতিউর রহমান বলেন, তিনি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলেন যে ছেলেটির মেধা রয়েছে। মাঝখানে খেয়াল করেন সে আর বিদ্যালয়ে আসে না। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন নিয়মিত মাঠের কাজ করার জন্য আমিন আলী ঠিকমতো বিদ্যালয়ে আসতে পারছে না। অন্য শিক্ষকেরা সেটা জানতেন না। তারা হয়তো বকাবকি করতেন। পরে তিনি শিক্ষকদের বলে দিয়েছিলেন, আমিন যে কয়দিনই বিদ্যালয়ে আসুক, তার বাড়তি যতœ নিতে হবে। তার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য বিদ্যালয় থেকে তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়েছে।
বাসস/ফই/স্বব/আহো/১৮৫৫/-ওজি