যশোরের মনকাড়া সুস্বাদু বিশেষ ধরনের পাটালি গুড়

1258

।। সাজ্জাদ গনি খাঁন রিমন ।।
যশোর, ১৯ জানুয়ারি, ২০২১ (বাসস) : মনকাড়া, সুস্বাদে বিভোর হতে চান পাটালি গুড়ের জন্য তারা নিশ্চয় জানেন যশোরের খাজুরা বাজারের নামটি। এই এলাকাতেই পাওয়া যায় দেশসেরা নলেন গুড় ও পাটালি।
জেলা সদরের কিসমত রাজাপুর গ্রামের পাটালি উৎপাদনকারী বশির আহমেদ দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করেন গুড়ের। এ ব্যবসা করে তিনি লাভবান হচ্ছেন। অন্যান্য কাজের পাশাপাশি বাড়তি উপার্জনের জন্য তিনি এ কাজ করতে পারছেন। এ কারণে প্রতি শীত মৌসুমে গ্রামে খেজুর গাছ কিনে নিজেই গাছ কেটে রস আহরন করেন। তার স্ত্রী রস জ্বালিয়ে তৈরি করেন সুস্বাদু নলেন গুড় ও পাটালি। এবারও ৪০টি গাছ শীত মৌসুমের জন্য কেনেন বশির আহমেদ। গুড়- পাটালি বিক্রি করে কামিয়েছেন বাড়তি টাকা। তিনি বলেন, দুই ভাঁড় রসে পাটালি হয় এক কেজি। কোন রকম ভেজাল ছাড়া এই যার দাম ৩শ থেকে ৪শ টাকা। প্রতিদিন তার রস হয় ২৫ থেকে ৩০ ভাড়। এ হিসেবে তার আয় কম নয়। বাড়তি জ্বালানী খরচ নেই। খেজুরের ডাল পাতা আর আশপাশের বাঁশ পাতা ও পরিত্যক্ত খড়ি দিয়ে চলে রস জ্বালানোর কাজ। শুধু কিসমত রাজাপুর গ্রামেই যে গুড় উৎপাদন হচ্ছে তা নয়। জেলার সর্বত্রই রয়েছে খেজুর গাছের আধিক্য। প্রতিটি গ্রামে দেখা যায় শীত মৌসুমে খেজুর গাছ কেটে রস আহরণের দৃশ্য। এসব খেজুর গাছ থেকে অনেকটা খরচহীন ভাবে উৎপাদন হয়ে থাকে গুড় পাটালি । তবে খাজুরার তৈরি গুড়ের রয়েছে বাড়তি কদর। এখানকার গুড়ের দেশ ছাড়িয়ে বাইরের দেশগুলোতেও রয়েছে ব্যপক চাহিদা। খাজুরা এলাকার বামনডাঙ্গা, তেজরোল, রাজাপুর গ্রামে যেন গুড় উৎপাদন একটু বেশি হয়। এসব গ্রামের অধিকাংশ কৃষক খেজুর গাছ কাটার সাথে জড়িত। চাহিদার কারণে কিছু অসৎ ব্যবসায়ী গুড়ের সাথে মিশিয়ে থাকে চিনি। কিন্ত এবার প্রশাসনের কঠোর নজরদারিতে অসৎ ব্যবসায়ীদের ভেজাল দেয়া কমে গেছে। কৃষক রহমত আলী বলেন, গুড়ের সাথে একটু চিনি না দিলে গুড় শক্ত থাকেনা। তাছাড়া রং উজ্জল করতে চিনির প্রয়োজন হয়। নইলে কালচে ভাব থেকে যায়।
আশেপাশের গ্রামগুলোতে খেজুরের রস, গুড় ও পাটালি উৎপাদনকে ঘিরে খাজুরা বাজারে গড়ে উঠেছে স্থায়ী কয়েকটি দোকান। তাছাড়া রাস্তার পাশে গুড়ের ভাঁড় আর পাটালির ডালি নিয়ে বসেন অসংখ্য বিক্রেতা। গুড়, পাটালি ব্যবসায়ী মুনির হোসেন বলেন, খাজুরা বাজার থেকে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ মণ গুড় বা পাটালি বিক্রি হয়। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা আসেন এব াজারে। শখের বশেও অনেকে কিনে নিয়ে যান গুড় বা পাটালি। অনেক প্রবাসী এখানে আসেন মিষ্টি গুড়ের স্বাদ নিতে।
নতুন মেয়ে জামাই বাড়িতে পাঠাতে অনেকে নলেন গুড়ের খোঁজে আসেন এ বাজারে। নলেন গুড় আসে এক বিশেষ ধরণের খেজুর রস থেকে যাকে নলেন রস বলে থাকে এ অঞ্চলের মানুষ। নলেন গুড় থেকে তৈরি হয় খেজুর গুড়ের বিস্ময় নলেন গুড়ের সন্দেশ, ক্ষির-পায়েস।
গাছি আবদুর রহিম জানান, আশ্বিনের শেষের দিকে খেজুরগাছকে প্রস্তুত করতে হয় রস আহরণের জন্যে। গাছের বাকল কেটে গেছে ‘গাছ তোলা’ হয়। গাছ তোলা শেষে গাছ কাটার পালা। কোমরে মোটা দড়ি বেঁধে ধারালো গাছিদা দিয়ে সপ্তাহে নির্দ্দিষ্ট দিনে গাছ কেটে রস আহরণ করা হয়।
রস পেতে হলে কিছু কাজ করতে হয়। গাছের উপবিভাগের নরম অংশকে কেটে সেখানে বসিয়ে দেয়া হয় বাঁশের তৈরি নালা। গাছের কাটা অংশ থেকে চুইয়ে-চুইয়ে রস এনে নল দিয়ে ফোটায় ফোটায় জমা হয় ভাঁড়ে। প্রথম রস একটু নোনা। গাছি এক কাটের পর বিরতি দেন। কিছুদিন বিরতির পর আবার কাটেন। এবারের রস সুমিষ্ট, সুগন্ধে মৌ-মৌ সারাদিক। এর সুবাস আর স্বাদ দিতে ভিড় জমায় পিঁপড়া, মৌমাছি, পাখি, কাঠবিড়ালী। এই রসের নামই নলেন রস। আর এটি কেবল যশোরের এই উপজেলাতেই সম্ভব। এ অঞ্চলের মানুষ রস দিয়ে তৈরি করেন নানা ধরণের পিঠা। গুড় দিয়েও তৈরি হয়। পিঠার পাশাপাশি বানানো হয় নানা ধরণের পাটালি। আকৃতি, রং ও স্বাদের দিকেও থাকে ভিন্নতা। এখানকার মানুষ নারিকেলের পাটালি বিশেষ পছন্দ করেন। যে পাটালি পাঠানো হয় তাদের স্বজন-আত্মীয় পরিজনকে। এসব ছাপিয়ে যায় একটি পাটালিতে। আর এই বিশেষ ধরণের পাটালি কেবল এখানকার কারিগররাই বানাতে পারেন। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বাইরে এই পাটালির আবরণ থাকে শক্ত। কিন্তু ভেতরটা গলে যাওয়া মোমের মত। এখানকার মানুষ বংশানুক্রমে এ পাটালি তৈরি করে আসছেন। সেসব বিক্রি হচ্ছে এ অঞ্চলে। খেজুর গাছের স্বল্পতা দেখা দিচ্ছে ইটের ভাটায় অবাধে গাছ পোড়ানোর কারনে।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট যশোর আঞ্চলিক কার্যালয়ের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. কাউসার উদ্দীন আমেদ বলেন, এই অঞ্চলের মাটি সাধারণত বেলে দোঁ-আশ। আর পানিতে লবনাক্ততা নেই। ফলে গাছের শিকড় অনেক নিচে পর্যন্ত যেতে পারে। সবমিলিয়ে জলবায়ু উপযোগী যশোরের খাজুরা, বাঘাপাড়া, মাগুরার শালিখায় খেজুরের রস সুগন্ধি ও সুস্বাদু হয়ে থাকে।
প্রেস ক্লাব যশোরের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান তোতা বলেন, ১৮৬১ সালে ইংল্যান্ডের নিউ হাউজ যশোরের চৌগাছার তাহেরপুরে খেজুরের গুড় থেকে ব্রাউন সুুগার তৈরি করে আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রকৃতিগতভাবে এই অঞ্চলের পানি মিঠা। একারণেই এই অঞ্চলের খেজুরের রস তুলনামূলক বেশি মিষ্টি ও সুস্বাদু।