বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : নারীদের নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে ‘স্বপ্ন’

319

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
স্বপ্ন-নারী
নারীদের নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে ‘স্বপ্ন’
॥ আতউর রহমান ॥
ঢাকা, ১৪ আগস্ট, ২০১৮ (বাসস) : ‘স্বপ্ন আমাদের নতুন করে বাঁচতে এবং দিনের আলোয় স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে’- ঠিক এভাবেই তাদের অভিব্যক্তির কথা জানাচ্ছিলেন স্বামী পরিত্যক্তা অথবা নানা কারণে সমাজের বঞ্চিত ও অসহায় নারীরা।
তারা বলেন, ‘সমাজ যখন আমাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তখন এই প্রকল্প আমাদের নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। আমরা এখন স্বাবলম্বী। সমাজও আমাদের সমীহের চোখে দেখে।’
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে বাস্তবায়নাধীন স্বপ্ন প্রকল্পের উপকারভোগী এই নারীরা বাসস-এর সঙ্গে আলাপকালে এভাবেই তাদের মনের কথা জানান।
তারা বলেন, গত আট মাসে তারা কয়েক দফায় টাকা তুলেছেন। প্রথম টাকা পেয়ে খাওয়া খরচ থেকে সামান্য সঞ্চয় করে কেউ ছাগল কিনেছেন, কেউ হাঁস মুরগী কিনে তা লালন-পালন করে বাড়তি আয় করছেন।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার এক ভবনের চর গ্রামের বাসিন্দা আরজিনা খাতুন (৪৮) জানান, প্রতিদিন কাজ করে দেড়শ’ টাকা পাই। সেখান ৫০ টাকা জমা রাখে। ১৮ মাস পরে যখন আমাদের সব জমা টাকা একত্রে ফেরত দেবে তখন আমরা নিজেরা এই টাকা দিয়ে কিছু একটা করতে পারবো বলে আশা করছি।
স্বামী নূরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তিন ছেলে নিয়ে বেশ অসহায় হয়ে পড়েছিলেন আরজিনা।
পরে তিনি গ্রামবাসীর মাধ্যমে স্বপ্ন প্রকল্পের কাজ করার খবর পেয়ে আট মাসে আগে কাজে যোগ দেন। তিনি কয়েক বার টাকা তুলেছেন। জানালেন, প্রথমবার ১২ হাজার ২০০ টাকা, দ্বিতীয়বার ৭ হাজার ৬৫০ টাকা ও তৃতীয়বার ৪ হাজার ২০০ টাকা পেয়েছি।
এমনি করে কাজ করে গত ৮ মাসে শিবরাম খামার গ্রামের বাসিন্দা সাথী বেগম (২৮) ও দুই নং শিবরাম গ্রামের বাসিন্দা লাভলী বেগম (২৫) নিজেরা কিছু টাকা জমা করে বাড়তি আয় করছেন। লাভলী বেগমের স্বামী রফিকুল ইসলাম আকস্মিকভাবে মারা যাবার পর ২ সন্তান নিয়ে বেশ অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। পরে এই কাজের সন্ধান পেয়ে তিনি গত ৮ মাস কাজ করে দুই সন্তান নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
সাথী বেগম জানান, ১২ জনের একটি দলে তিনি কাজ করছেন। ১৮ মাস কাজ করার পর যে টাকা পাবেন তা দিয়ে তিনি ব্যবসা করবেন।
ইউএনডিপি সরকারি সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে উপকূলবর্তী, দুর্যোগ ঝুঁকিপ্রবণ এবং দারিদ্র পীড়িত ২২ টি জেলায় উৎপাদনশীল ও সম্ভাবনাময় কর্মে ও সুযোগ গ্রহণে নারীর সামর্থ উন্নয়ন প্রকল্প ‘স্বপ্ন’ এপ্রিল ২০১৫ থেকে ডিসেম্বর ২০১৯ মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মোট ৮৫৩ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে দেশের ১০৩০ টি ইউনিয়নে এই প্রকল্পটির কাজ চলছে।
বর্তমান সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে অতিদরিদ্র নির্মূলের লক্ষ্যে গ্রাম পর্যায়ে নারীদের ক্ষমতায়ন ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে উপার্জনক্ষম করে গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ২৬ মে প্রকল্পটি অনুমোদন দেন। ইউএনডিপি ছাড়াও এসডিজিএফ, আইএলও এবং বিএসআরএম প্রকল্পটিতে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে বলে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এমদাদুল্লাহ মিয়া জানিয়েছেন।
প্রকল্প সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশে জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা না গেলে অর্থনীতির বুনিয়াদ শক্তিশালী করা সম্ভব নয়। উপকূলীয় অঞ্চলে নারীরা সবচেয়ে বেশি অসহায়। এ প্রকল্প গ্রামীণ দরিদ্র ও অসহায় নারীদের কারিগরী ও কর্ম সহায়ক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে পারছে।
প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি ইউনিয়নে বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, অসহায়, স্বামী কাজ করতে অক্ষম প্রতিটি ইউনিয়নে মোট ৩৬ জন মহিলাকে ১৮ মাসের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ নির্ধারিত বিভিন্ন রাস্তা-ঘাট মেরামত, পুকুর ও মাঠ সংস্কার, বাধ সংস্কার ও মেরামত, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি বিবিধ কাজে দৈনিক ২০০ টাকা মজুরী প্রদান করা হয়। যা থেকে ৫০ টাকা বাধ্যতামূলক সঞ্চয় হিসেবে স্থানীয় ব্যাংকসমূহে সংরক্ষিত ব্যাংক হিসাবে জমা করা হয়। মহিলাদেরকে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, নারী-পুরুষ সম্পর্ক উন্নয়ন, নারী অধিকার, জলবায়ু পরিবর্তন ও দূর্যোগ মোকাবেলা, স্বশিক্ষণ, সহজ হিসাব, নেতৃত্ব উন্নয়ন এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের করণীয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ে কুড়িগ্রাম ও সাতক্ষীরা জেলার ১৪টি উপজেলার ১২৪টি ইউনিয়নের মোট ৪ হাজার ৪শ ৬৪ জন মহিলা উপকারভোগীকে নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো, সারাদেশে ৬৫ হাজার দুস্থ নারীর ক্ষমতায়ন ও একটি অনুকরণীয় মডেল প্রতিষ্ঠা করা।
দেশের দারিদ্র ও অতিদরিদ্র দূরীকরণে বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পের চেয়ে এ প্রকল্পটি ভিন্ন মাত্রা আনছে। উপকারভোগীদের আয়ের একটি অংশ সঞ্চয় হিসেবে জমা থাকার কারণে কাজের মেয়াদ শেষে তারা সে অর্থ দিয়ে ক্ষুদ্র আকারে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে পারছে। এছাড়াও বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি পোশাক শিল্পসহ নানা খাতে কাজ করে দারিদ্রের অভিশাপ হতে মুক্তি পাচ্ছে।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/এমএআর/আরজি/১৮৪৩/আহো/-ওজি