বধ্যভূমিতে যেভাবে লাশ শনাক্ত, বোনের হাতে বোনা সোয়েটার ছিল অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিনের কঙ্কালের গায়ে

1333

॥ কানাই চক্রবর্ত্তী ॥
ঢাকা, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২০ (বাসস) : ‘গর্তটার সবচেয়ে উপরে ছিল ইতিহাস বিভাগের সন্তোষ ভট্টাচার্যের কঙ্কাল- হ্যাঁ কঙ্কালই বলা চলে, তার পরনে ছিল লুঙ্গি। তারপর মনে হয়, ড. সিরাজুল হক খানের। তার ছেলে চিনলো কোমরের বেল্ট আর প্যান্ট থেকে। ইতিহাসের অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিনকে চেনার তো উপায় ছিল না। যারা শনাক্ত করলেন, তাঁরা বললেন- হ্যাঁ এই তো দারোয়ানের গামছা দিয়ে হাত পিছনে বাধা, পরনে বোনের বর্ণিত ডোরাকাটা লুঙ্গি, বোনের বোনা সোয়েটার কঙ্কালের গায়ে।’
এ বর্ণনা মিরপুর থানার শিয়ালবাড়ির বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের লাশ শনাক্তকারী ওমর হায়াতের। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন এবং মূলত ডাক্তার মূর্তজার লাশ শনাক্ত করতে বধ্যভূমিতে গিয়েছিলেন। আর ওমর হায়াতের বরাত দিয়ে এ বর্ণনার কথা লিখেছেন আরেক শহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার সহধর্মিনী বাসন্তী গুহঠাকুরতা। ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘একাত্তরের স্মৃতি’ গ্রন্থে বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন তিনি।
১৯৭১ সালে ঠিক বিজয়ের পূর্বমুহূর্তে দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসর রাজাকার আল-বদর, আল-শামস মিলিতভাবে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঠিক দুই দিন পর ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বাধীন বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
বাসন্তী গুহঠাকুরতা বিশ^বিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনে থাকতেন। তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন ২৫ মার্চের ভয়াল রাত। সে রাতে পাকিস্তানী সেনাদের গুলিতে আহত হয়ে তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে ৯ মাস লড়াই করেছেন বেঁচে থাকতে এবং একমাত্র কন্যাকে বাঁচিয়ে রাখতে। নিজ অভিজ্ঞতার পাশাপাশি তিনি সেই সময়ে অনেক কিছু দেখেছেন, অনেব কিছু শুনেছেন। অনুভবের সেইসব জীবন সায়াহ্নে এসে এই বইতে তা তুলে ধরেছেন।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এলাকা থেকে যে আটজনকে তুলে নেয় ইয়াহিয়ার শকুনরা, তারা সবাই ফিরে এসেছেন, তবে জীবন্ত নয়, মিরপুর থানার ট্রাকে চড়ে বাক্সবন্ধি লাশ হয়ে। ইয়াহিয়া ভুট্রোর নীল নকশার শিকার এরা। আসন্ন বিজয়ের মুহূর্তে বিহারী-বাঙালি-আলবদরসহ হানাদারদের দোসররা বিষাক্ত সাপের ফণা তুলে মরন ছোবল দিয়েছে এই প্রতিভাধর এই মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবীদের।
বাসন্তী গুহঠাকুরতা বলেন, একাত্তরের ডিসেম্বর থেকেই বেছে বেছে তালিকা মিলিয়ে বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে গেছে কসাইরা। এ মাসের ১২ তারিখ থেকে ১৫ ও ১৬ তারিখ পর্যন্ত ওদের ছদ্মবেশী গাড়িগুলো পাড়ায় পাড়ায় হানা দিয়েছে বারবার। সকল বাড়ির  আত্মীয়দের কাছে জেনে হিসাব করে দেখা গেছে প্রায় দেড়ঘন্টা সময়ের মধ্যে তাদের তুলে নেয়ার কাজ শেষ হয়েছে। সকাল সাড়ে আটটায় ডাক্তার মূর্তজাকে, তার আগে একজনকে গাড়িতে চোখ বাধা অবস্থায় দেখা গিয়েছিল। বিজয় দিবসের বেলা ১০টা পর্যন্ত ওরা হায়েনার মত ওরা খুঁেজ বেড়িয়েছে শিকার।
যাদেরকে তুলে নেয়া হয়েছিল ১৪ তারিখে, তারা কেউ ফিরে আসেননি। জানুয়ারির ২ তারিখে (১৯৭২) মিরপুর থানা থেকে পাড়ায় খবর আসে শিয়ালবাড়ির বধ্যভূমিতে কিছু লাশের সন্ধান পাওয়া গেছে। পরের দিন ৩ জানুয়ারি সকালে নিখোঁজদের আতœীয়স্বজন সেখানে লাশ সনাক্ত করতে যেতে পারবেন। অনেকেই সেদিন সকাল সাড়ে আটটায় শিয়াল বাড়িতে লাশ শনাক্ত করতে যান। আসলে ২০ দিন পরে লাশ শনাক্ত করা ছিল কঠিন কাজ।
বাসন্তী গুহঠাকুরতা জানান, তাঁর সেই সময়ের প্রতিবেশি, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষক ওমর হায়াত ডাক্তার মূর্তজার লাশ শনাক্ত করতে গিয়েছিলেন। মিরপুর থানার জিপে তাঁর সঙ্গে আরো ছিলেন সন্তোষ ভট্র্যাচার্যের ছেলে পিন্টু, ড. সিরাজুল হক খানের ছেলে পিয়ারুসহ আরো অনেকে।
দীর্ঘ ১৮ বছর পরে ওমর হায়াত বাসন্তী গুহঠাকুরতার কাছে লাশ শনাক্ত হওয়ার বর্ননা দেন। তিনি জানান, জিপ থেকে নামার পর মিরপুর দরগার কাছাকাছি যেখানে এখন বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধ তার পাশ দিয়ে কাটা ধান ক্ষেতের মধ্যে চলে যাওয়া কাদাময় রাস্তায় তারা সবাই হেঁটে যান। কিছুদুর গিয়ে দেখতে পান এলো মাটি খোঁড়া হচ্ছে। পাশাপাশি দুটি গর্ত ছিল। বোধ হয় একেকটিতে চারজন করে ফেলা হয়েছিল।
বাসন্তী গুহঠাকুরতার সেই সময়ের পাশের ফ্লাটের নিকটতম সুহৃদ হায়াত সাহেব দম নিয়ে বলতে থাকেন ‘গর্তটার সবচেয়ে উপরে ছিল ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সন্তোষ ভট্রাচার্যের কঙ্কাল- হ্যাঁ কঙ্কালই বলা চলে- তার পরনে ছিল লুঙ্গি। তারপর মনে হয় ড. সিরাজুল হক খানের।’ ওমর হায়াত আবার বলতে থাকলেন, ‘এর মধ্যে পলার স্বামী ডা. মূর্তজার শরীরটাই চেনা গিয়েছিল। তার ছিল ডন-কুস্তি করা পেটানো পোক্ত শরীর। তাছাড়া দু’জনের নিচে ছিলো তার লাশটা। তার পায়ে ছিল একপাটি জুতা, পরনে লুঙ্গি। তাঁর চোখ বাঁধা ছিল তাঁর সাড়ে তিন বছরের মেয়ে মিতির লাল শাড়ি দিয়ে। মনে হচ্ছিলো গামছাই বুঝি। বুকে কতো যে গুলির ছিদ্র আর কপালে গায়ে বেয়নেটের দাগ।’ ইতিহাসের অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিনকে চেনারতো উপায় ছিল না। যারা শনাক্ত করলেন, তারা বললেন, – হ্যাঁ এই তো দারোয়ানের গামছা দিয়ে হাত পিছনে বাধা, পরনে বোনের বর্ণিত ডোরাকাটা লুঙ্গি, বোনের বোনা সোয়েটার কঙ্কালের গায়ে।’
দুইবন্ধু অধ্যাপক আনোয়ার পাশা (বাংলা) আর রাশীদুল হাসান (ইংরেজি) কে চেনার উপায় না থাকলেও চেনা যায়, তাদের আপনজনের বর্ণনায়। একই ফ্লাটে থাকা দু’দুবন্ধুকে একই সঙ্গে তুলে নেয়া হয়েছিল একই বাসে। একজনের পরনে ছিল লুঙ্গি ও হাওয়াই শার্ট, আরেকজনের পরনে পায়জামা পাঞ্জামি। দুজনের গায়ে প্রায় একইরকমের চাদর। চেনার উপায় ছিল এসব দিয়েই-বলেন ওমর হায়াত। ইতিহাসের ড. আবুল খায়ের ১৪ ডিসেম্বর সকালে বাইরে শীতের রোদ পোহাচ্ছিলেন শাল গায়ে দিয়ে, শালটায় তার পরিচয় দিয়েছে। আর শিক্ষা ও গবেষণার ফয়জুল সাহেবকেও জামাকাপড় দিয়ে চেনা গেছে।
বাসন্তী গুহঠাকুরতা বলেন, সন্তোষ ভট্টাচার্য ছাড়া বাকি সাতজনের দাফন হয়েছে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় মসজিদের কোনায়। আর সন্তোষ বাবুর গলিত লাশ গেছে পোস্তাগোলার শ্মশানে। তার ছেলে মুখাগ্নি করেছিল কিনা কেউ দেখেনি। সে শ্মশানেও যায়নি।
বাসন্তীর স্বামী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মরদেহ বিষয়ে তিনি বলেন, ২৫ মার্চের পর চারদিন তার লাশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় ছিল। তার পর আর তাদের সাহস ছিল না মর্গে গিয়ে খোঁজ নেয়ার। তখন হিন্দুরা শ্মশানে যেতেই পারতো না। তবে, বিজয়ের পরে বন্ধু ডাক্তার শহিদুল্লাহকে নিয়ে একদিন মর্গে গিয়েছিলেন। জানতে চাওয়া মাত্রেই ওরা বলেছিল ‘ওঃ অধ্যাপক? হিন্দু? আমরা তাকে লালবাগের শ্মশানে পোড়াই দিছি।’ এখন প্রশ্ন হচ্ছে হিন্দুমরা লালবাগে কেন ? সেখানে কি শ্মশান আছে। অন্যদিকে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি চিকবালি তাকে বলেন, ‘মা আমি মর্গের লোকদের বলেছি-এ আমাদের বাবু। তাকে এখানে কবর দিয়ে রাইখো। আমি একটা ক্রসচিহ্নও দিয়া আইছিলাম। অথচ এর কয়েক দিন পরে একজন রাজনৈতিক নেতা বাসন্তীকে বলেছিলেন, তিনি হাসপাতালে খোঁজ নিয়েছিলেন। হলের ডোম ঝাড়–দাররা বলেছে ওনাকে টাকার জন্য দাহ করা যাচ্ছে না। তখন তিনি তাদের চল্লিশ বা পঞ্চাশ টাকা দিয়ে এসেছিলেন। এ কথা শুনে তিনি চিকবালিকে কোনটা সত্য জানতে চেয়েছিলেন। লালবাগে কবর দেয়া, না লালবাগ শ্মশানে পোড়ানো? চিকবালির এক কথা ‘সত্য কথা কয়বার কওন যায়?’
না, তিনি জীবতদ্দশায় জেনে যেতে পারেননি তার স্বামীকে কবর দেয়া হয়েছিল, নাকি পোড়ানো হয়েছিল। এই কষ্ট নিয়েই ১৯৯৩ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরন করেন বাসন্তী গুহঠাকুরতা। তিনি ১৯৪৪ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি গেন্ডারিয়া মনিজা রহমান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।