ব্রহ্মপুত্র-তিস্তার চরে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবায় কমিউনিটি ক্লিনিক

1095

ঢাকা, ১০ ডিসেম্বর, ২০২০ (বাসস) : সময়টা ২০০২ সালের মধ্য জুলাই। সফর উদ্দিনের দুই সন্তান রেখে পরপারে পাড়ি জমান তার গর্ভবতী স্ত্রী ছালেহা খাতুন। হঠাৎ করে স্ত্রীর শরীর খারাপ হয়ে যায়। তাৎক্ষণিক নৌকায় করে স্ত্রী নিয়ে স্থানীয় উপজেলা হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। কিন্তু পথেই তার মৃত্যু হয়।
স্ত্রীর মৃত্যুর পর দুই শিশুকে নিয়ে যেন অকূল পাথারে পড়েন সফর উদ্দিন। শুধু সফর উদ্দিনই নয়, একটা সময় তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের দুর্গম চরাঞ্চলে গর্ভবর্তী নারীসহ নি¤œ আয়ের মানুষকে এভাবেই বিনা চিকিৎসায় মরতে হতো। বিশেষ করে শিশু ও মায়েদের। তবে সময় পাল্টেছে।
চরেও এখন নিয়মিত ‘হাসপাতালে’ গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে বিনামূল্যে ওষুধ নিয়ে বাড়ি ফেরেন নারী-পুরুষেরা। এভাবে দেশজুড়ে স্থাপিত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো ‘হাসপাতালে’ রূপ নিয়েছে।
চিলমারীর থানাহাট গ্রামের বাসিন্দা সফর উদ্দিনের ভাষ্য, যদি তখন এ ধরনের কমিউনিটি ক্লিনিক কিংবা স্বাস্থ্যসেবার কোনো সুযোগ বাড়ির কাছে থাকতো তাহলে তার স্ত্রীকে এভাবে অকালে প্রাণ দিতে হতো না।
কুড়িগ্রামের চিলমারী থানার ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে চর কোদালকাটির বাসিন্দা আবদুল আলীম। তিনিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। কিন্তু তার অকাল মৃত্যুতে দু’চোখে রাক্ষুসে ব্রহ্মপুত্রের অতল জলরাশি ছাড়া কিছুই দেখছিলেন না তার বিধবা স্ত্রী আছিয়া।
স্বামী হারানোর শোক কাটতে না কাটতেই তাকে শুরু করতে হয় জীবনের আরেক কঠিন সংগ্রাম। স্বামীর পাঁচ কাঠা জমির সাড়ে তিন কাঠা চলে গেছে নদীগর্ভে। বাকিটুকুতে বেঁচে থাকার তাগিদে শুরু করেন চাষ-বাস। এরই মধ্যে অতি পরিশ্রম আর দুঃশ্চিন্তায় তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। ওষুধপত্র কেনার মতো টাকা নেই তার। এ অবস্থায় তাকে কমিউনিটি ক্লিনিকের খোঁজ দেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য রহমতউল্লাহ।
কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে স্বাস্থ্য সহকারীর পরামর্শ ও বিনামূল্যে ওষুধ নিয়েছেন। এখন তিনি বেশ ভালো। আছিয়ার ভাষ্য, “আগে ওষুধ কিনি খাইবার পারি নাই। এখন ফ্রি ফ্রি ওষুধ খাচ্ছি। শরীর ভালো থাকে। অসুখ আর বাসা বাঁধবার পারে না।”
স্থানীয় লোকজন বলছেন, চরের মানুষ বেশ দুঃখী। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গেই তাদের বসবাস। কখনও নদীভাঙন তো আরেক সময় বন্যা। তাই সব হারিয়েও মানুষগুলো সামান্য প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা পেলে অসাধ্য সাধন করতে পারেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের মিলনস্থলের এক বিশাল চর এলাকা নানাবিধ দুর্যোগের শিকার। বিশেষ করে বন্যা, নদী ভাঙন, শৈত্যপ্রবাহ. ঘূর্ণিঝড়, সঙ্গে রয়েছে খরা। ফলে বছরের একটা সময় এ অঞ্চলে তীব্র খাদ্য সংকট বিরাজ করে।
নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে এক ভঙ্গুর পরিবেশে বসবাসকারী বিপুলসংখ্যক মানুষ অতি দারিদ্র্যের কবলে পড়েন। এক্ষেত্রে চিকিৎসা তো দূরে থাক, খাবার সংগ্রহের পেছনেই অতি দারিদ্র্যের শিকার মানুষগুলোকে ছুটতে হয়। তাই চরে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বেশ আর্শীবাদ হয়ে এসেছে।
চিলমারী বাজার এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতি বছরই আমাদের দুর্যোগে পড়তে হয়। বিশেষ করে বন্যা। আছে নদী ভাঙন। ফলে ফসলি জমি কমে যাচ্ছে। তাই বিপুলসংখ্যক মানুষ পুরোনো ঘর-বাড়ি ভেঙে বাঁধের ওপরে এসে ঠাঁই নেন। তারা টাকার অভাবে কোনো চিকিৎসা করাতে পারেন না। ফলে চিকিৎসাহীন অবস্থায় অনেকে অকালে মারা যান। এক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের ফলে সর্বহারা এসব মানুষ খুবই উপকৃত হচ্ছেন।
১৭ বার নদী ভাঙনের শিকার এই বৃদ্ধের চোখে মুখে সব হারানোর বেদনার বিষণœ গাঁথা। তবুও নতুন করে বাঁচার স্বপ্নে বিভোর তিনি। স্থানীয় স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রফিকুল বলেন, এখানকার মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গৃহায়ন ও জীবনচলার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এছাড়া চরাঞ্চল দ্বীপের মতো হওয়ায় মানুষগুলো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তাই উন্নত চিকিৎসার জন্য শহরাঞ্চলে গেলে তাদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। অনেকের যাওয়ার অর্থও থাকে না।
সূত্র জানায়, কমিউনিটি ক্লিনিকে নারীদের প্রসব-পূর্ব (গর্ভকালীন), প্রসবকালীন, প্রসবোত্তর অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্রদান করা হয়। তবে কোনো জটিলতা দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব জরুরি প্রসূতি সেবা কেন্দ্রে পাঠনো হয়। এছাড়া সদ্য প্রসূতি মা (৬ সপ্তাহের মধ্যে) এবং শিশুদের (বিশেষত মারাত্মক পুষ্টিহীন, দীর্ঘমেয়াদী ডায়ারিয়া এবং হামে আক্রান্ত) ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়।
এছাড়া মহিলা ও কিশোরীদের রক্তস্বল্পতা শনাক্ত করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান, কিশোর-কিশোরীদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ প্রদান, ইপিআই সিডিউল অনুযায়ী শিশুদের প্রতিষেধক (যক্ষা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কফ, পোলিও ধনুষ্টংকার, হাম, হেপাটাইটিস-বি) এবং ১৫-৪৯ বছর বয়সী মহিলাদের ধনুষ্টংকার প্রতিষেধক টিকাদান, ১৫ বছর বয়সের নিচের শিশুদের মধ্যে সন্দেহজনক একিউট ফ্লাক্সিড প্যারালাইসিস (এএফপি) শনাক্ত, এক থেকে পাঁচবছর বয়সী শিশুদের ৬ মাস পরপর প্রয়োজনীয় পরিমাণ ভিটামিন-এ খ্যাপসুল খাওয়ানো এবং রাত কানা রোগে আক্রান্ত শিশুদের খুঁজে বের করে চিকিৎসা প্রদান, ডায়ারিয়া আক্রান্ত রোগীকে খাওয়ার স্যালাইন ও জিংক বড়ি (শিশুদের ক্ষেত্রে) প্রদান, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন নিশ্চিত করা এবং নবজাতকের অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্রদান করে কমিউনিটি ক্লিনিক। পাশাপাশি বিনামূল্যে ওষুধ প্রদান করা হয়।
রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধার চরগুলো বরাবরই দুর্যোগপ্রবণ। নদী ভাঙনের কারণে এ অঞ্চলে বছর বছর চর জেগে উঠছে। বর্ষায় পানির নীচে চলে যায় এসব চরভূমি। বর্ষা শেষে ফের জেগে ওঠে। ফলে এসব বালুচর অনেকটা মরুভূমির মতো দেখায় তখন।
জানা যায়, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের জন্য ১৯৯৬ সালে সরকারিভাবে প্রকল্প পাস হয়। কাজ শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। এরই ধারাবাহিকতায় চরাঞ্চলের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্লিনিকগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন মানুষ।
এদিকে ২০০১ সালে দেশজুড়ে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো চালু হলেও একই বছরের শেষ দিকে এগুলোর কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে যায়। তৎকালীন সরকার এসব কিøনিকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
পরবর্তীতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ফের চালু হয় কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম।
কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মো. হাবিবুর রহমান জানান, বর্তমানে সপ্তাহে ছয়দিন ক্লিনিকগুলো খোলা থাকছে। কোনো কোনো ক্লিনিকে প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০ জন রোগী আসছে। এসব ক্লিনিকে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, টিকাদান কর্মসূচি, পুষ্টি, স্বাস্থ্যশিক্ষা, পরামর্শসহ, হাঁপানী ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন রোগের সেবা দেয়া হচ্ছে। বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে ৩০ ধরনের প্রাথমিক ওষুধও।
নারী ও শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা ডা. নাজনীন আক্তার বলেন, চরগুলোতে সাধারণত প্রচলিত ফসলের চাষ হয় না। ফলে ফলে বাঁধের ওপর বসবাসকারী পরিবারগুলোর ছেলে-মেয়েরা প্রােয়জনীয় স্বাস্থ্য ও পুষ্টি গ্রহণ থেকেও বঞ্চিত। তবে সরকার ও বিভিন্ন এনজিও-এর উদ্যোগে এখন চরাঞ্চলের অবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে।