শিশুর কল্যাণে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ, পুষ্টি, শিক্ষা ও বিনোদনের কোন বিকল্প নেই

953

ঢাকা, ৮ ডিসেম্বর, ২০২০ (বাসস/ইউনিসেফ) : শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। প্রতিটি শিশু-কিশোর শারীরিক ও মানসিক বিশেষ যত্নের দাবীদার। জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদেও এ কথা উল্লেখ রয়েছে।
বিশ্বব্যাপি শিশুদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ১৯২৪ সালে জেনেভায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে ’শিশু অধিকার’ ঘোষণা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৯ সালে জাতিসংঘে শিশু অধিকার সনদ ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ এই সনদে স্বাক্ষর করে। বর্তমান আইনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যাক্তিকে শিশু হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
একটি শিশুকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই শিশুর পারিবারিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শিশু অধিকার সনদে ৫৪টি ধারা এবং ১৩৭টি উপ-ধারা আছে। এই উপ-ধারাগুলোতে বলা হয়েছে, শিশুদের ক্ষেত্রে কোন ধরণের বৈষম্য করা যাবে না। সমাজকল্যাণমুলক কাজ এবং আইনের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য হবে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ। রাষ্ট্রসমুহ শিশুদের পরিচর্যা ও সরকার শিশুদের সেবা এবং সুবিধাদি প্রদান করবে। শিশুদের মৌলিক অধিকার যেমন: শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি অধিকারগুলো নিশ্চিত করবে।
কিন্তু নানা কারণে এর ব্যতয় ঘটে আমাদের সমাজে। আদর-যতœ, সঠিক দিকনির্দেশনা ও বিদ্যমান পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিরূপ প্রভাবে অনেক শিশু-কিশোর প্রত্যাশিত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়। ছোট-ছোট ভুল করতে-করতে একসময় তারা এমন সব কর্মকা-ে জড়িয়ে যায়, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন ও মূল্যবোধের পরিপন্থী। বিঘিœত হয় রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা। কিশোরদের এমন কর্মকা-ই কিশোর অপরাধ বলে বিবেচিত। তারা সমাজের চোখে কিশোর অপরাধী হিসেবে আখ্যায়িত হয়।
বিশ্বে শতকরা ২৬ ভাগ মানুষের বয়স ১৫ বছরের নিচে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫শতাংশ শিশু। তাদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ শিশুই দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। একটি জরিপে দেখা যায়, দরিদ্র শিশুদের ৬৪শতাংশ স্বাস্থ্যসম্মত পয়োঃনিস্কাশন সুবিধা, ৫৯শতাংশ তথ্য লাভের অধিকার, ৪১শতাংশ বাসস্থান এবং ৩৫শতাংশ বিশুদ্ধ খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়। ’বাংলাদেশে শিশুশ্রমের অবস্থান’ শীর্ষক এক সমীক্ষায় শিশুশ্রমের কারণ হিসেবে যে কারণগুলো দেখানো হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে : চরম দারিদ্র্য, পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীর মৃত্যু, পিতৃবিয়োগ, বাবা-মা পরিতাজ্য ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি।
শিশু অধিকার সংরক্ষণ ও শিশু কল্যাণে শিশুর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ, পুষ্টি, শিক্ষা ও বিনোদনের কোন বিকল্প নেই। তাই শিশু-কিশোর কল্যাণে জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী শিশু অধিকার সংরক্ষণ, শিশুর জীবন ও জীবিকা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসুচি পরিচালনাসহ শিশু নির্যাতন বন্ধ, বিশেষ করে কন্যাশিশুদের বৈষম্য বিলোপ সাধনে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে শিশু স্বার্থ ও অধিকার রক্ষা এবং শিশু কল্যাণের লক্ষ্যে ২০১১ সালে গৃহীত হয়েছে ‘জাতীয় শিশু নীতি’। এছাড়া নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘পারিবারিক সহিংসতা আইন ২০১০’। শিশুশ্রম নিরসনকল্পে ‘জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০’ প্রণয়ন করা হয়েছে। ঝুকিপুর্ণ কাজ থেকে শিশুদের বিরত রাখার জন্য শিশুশ্রম নিরসন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। যার ফলে আগামী তিন বছরে ৪০ হাজার শিশুকে ঝুকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে এনে তাদের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান করা হবে। যাতে তারা পিতামাতাকে তাদের কাজে সহায়তা করতে পারে।
পারিবারিক অসচ্ছলতা কাটাতে শ্রমজীবী শিশুদের প্রচন্ড স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে। চিকিৎসকদের মতে শিশুরা দীর্ঘদিন ধরে হোসিয়ারি শিল্প কারখানার মতো ধুলিময় পরিবেশে কাজ করলে তাদের শ্বাসকষ্ট ও ব্রংকাইটিস রোগ হতে পারে। এ ছাড়া ওয়ার্কশপের মতো কারখানায় মেটাল ডাস্টের মধ্যে যদি শিশুরা কাজ করে তবে ফুসফুসের ক্যানসারও হতে পারে। ২০০৬ সালের বাংলাদেশ শ্রম আইনের ১ থেকে ১৪ এবং ১৯৭৫ সালের শিশু আইনে বলা হয়েছে, শুন্য থেকে ১৬ বছরের শিশুদের ভারী কাজ করানো যাবে না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এই আইন মানা হচ্ছে না।
শিশুরা বড় হবে, একদিন স্কুল পাশ করে কলেজে ভর্তি হবে। তারা শিক্ষিত হবে। জ্ঞান অর্জন করবে। মানবিক মুল্যবোধ বাড়বে। তখন একটা পরিবর্তন হয়তো আসতে পারে। আইনে বলা আছে ১৮ বছর পর্যন্ত সবাই শিশু। তা হলে ১৮ বছরের আগে শিশুদের ঝুকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করা বন্ধ করতে হবে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তবেই হয়তো একদিন আমাদের সমাজ থেকে ঝুকিপুর্ন শিশুশ্রম নিরোসন সম্ভব হবে।