অনলাইন বাণিজ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন নারী উদ্যোক্তারা

810

ঢাকা, ৯ আগস্ট, ২০১৮ (বাসস) : রুবাইয়াত উর্মি। নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ-এমবিএ করে চাকরি না খুঁজে ছোট পরিসরে নিজের ফেসবুকে গ্রুপ খুলে এফ-কমার্সের মাধ্যমে শুরু করেন অনলাইন বাণিজ্য। এর মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার বড় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন।
উর্মি ছাত্রজীবন থেকেই স্বপ্ন দেখেন ব্যবসার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার। তাই প্রথমে ছোট আকারে খুব অল্প পুঁজিতে শুরু করেন। পরে আস্তে আস্তে পরিধি ডালপালা ছড়ায়। উর্মির এফ-কমার্স পেজের নাম ‘ফ্যাশন প্যাশন’। তিনি লোকাল বাজার থেকে কাপড় কিনে ডেভেলপ করেন। যেহেতু আমাদের দেশে অনেকেই দেশীয় পণ্য ব্যবহারে আগ্রহী নন, তাই দেশীয় বিভিন্ন পোশাক কিভাবে গর্জিয়াস কাজ করে পার্টি ড্রেস বানানো যায় তা নিয়ে কাজ করছেন উর্মি।
আলেয়া আফরিন। একটি অ্যাড ফার্মে চাকরির পাশাপাশা আরেকটু স্বাবলম্বী হওয়ার জন্যই এই এফ-কমার্সে তার যাত্রা। এইচএসসি পাস করতেই বাবা সমস্যায় পড়ে চাকরি ছাড়েন। ঠিক তখনি বড় মেয়ে হিসেবে সংসারের হাল ধরার দায়িত্ব পড়ে আলেয়ার ঘাড়ে। আলেয়া খুব সামান্য বেতনে ছোট একটি চাকরি শুরু করেন। প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তার পড়ালেখা। সামান্য বেতনে পরিবারে ছোট ভাইসহ অন্যদের দেখভালেই চলে যায়, পড়াশোনার খরচ যোগানোই দায়। তখনি এই এফ-কমার্সে চিন্তা এলো এবং সেভাবেই শুরু তার ‘বিবির আয়না’ নামে এফ-কমার্স পেজের। তারপর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স। এখনো চাকরি করছেন ভালো কোম্পানিতে। পাশাপাশি তার সেই এফ-কমার্স ব্যবসাও ধরে রেখেছেন। মাত্র ২৫ হাজার টাকা ধার করে শুরু করেছেন, এখন প্রায় তিন লাখ টাকার প্রোডাক্ট রয়েছে বিবির আয়নায়।
উর্মি আর আলেয়ার মতো শত শত উদ্যোগী মেয়ে অনলাইন বাণিজ্যে এগিয়ে যাচ্ছে ও সফল হচ্ছে। দেশ এখন আলিবাবা, দারাজ, আজকের ডিল, পিকাবোসহ অন্যান্য ই-কমার্স সাইটে সয়লাব। বর্তমান যান্ত্রিক কর্মব্যস্ত দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই তো প্রযুক্তিনির্ভর। পিছিয়ে নেই ঘরের নারীরাও। বর্তমানে নারীর ঝোঁক বাড়ছে অনলাইন ব্যবসায়। অনলাইন ফ্যাশন হাউজ, জুয়েলারি হাউজসহ নিত্যপণ্যের সম্ভার এখন প্রায়ই চোখে পড়ে। ঘরে বসে কল করে কিংবা মেসেজ পাঠিয়ে পছন্দের পণ্যটি ক্রেতাদের হাতের নাগালে পৌঁছে দিচ্ছেন এ নারী উদ্যোক্তারা। শুধু সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ফেসবুক ব্যবহার করেই তারা এগিয়ে নিচ্ছেন নিজেদের ব্যবসা।
ফেসবুকের মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তির এই সম্ভাবনার যুগে নারীর পথচলা আরও সুগম হয়েছে। ঘর-সংসার-সন্তান সব সামলে অনেক নারী এখন অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত এফ-কমার্সে।
বর্তমানে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিস (বেসিসের) তালিকাভুক্ত প্রায় তিন হাজার ফেসবুক পেজ আছে। এর মধ্যে প্রায় ৭০০ পেজ নারী উদ্যোক্তাদের। ফেসবুক পেজ বা গ্রুপ (এফ-কমার্সের) সুবিধা হলো- অল্প পুঁজিতে এমনকি বিনা পুঁজিতেও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়াই ব্যবসা করা যায়। বর্তমান তথ্য অনুযায়ী আট হাজার ফেসবুক পেজ আছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক পেজ চালান নারী উদ্যোক্তারা।
এ প্রসঙ্গে লেখিকা আমেনা খানম মীনা বলেন, খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, ১০ থেকে ১৫ বছর আগেও আইসিটি বা তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে একচেটিয়া বিচরণ ছিল পুরুষদের। মূল কারণ, কম্পিউটার তথা আইসিটি খাতে শিক্ষা, সেবা ও ব্যবসায় যারা নিয়োজিত ছিলেন, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন পুরুষ। কিন্তু এখন আর সে অবস্থা নেই। খুব ধীরে হলেও পাল্টেছে এ চিত্র। বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে এসেছেন তথ্যপ্রযুক্তিতে।
তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো ও নারী সচেতনতার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপও নিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় মহিলা সংস্থার একটি প্রকল্প ছিল ‘জেলাভিত্তিক মহিলা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ’।
নানা বাধা পেরিয়েও দেশের আইসিটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা নারীর সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নিয়োজিত নারীরা নিজেদের অবস্থা সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলছেন। বাংলাদেশেও গড়ে উঠছে এমন সংগঠন। তেমনি একটি ‘বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজি’ বা বিডব্লিউআইটি। সংগঠনটির নারীরা কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশের আইসিটি খাতের সাথে জড়িত। বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতে পেশাগতভাবে জড়িত নারীদের এখন পর্যন্ত প্রধান সংগঠন এটি। সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য আইটি খাতের সাথে জড়িত নারীদের একত্রিত করে তাদের পরিচিতির ব্যবস্থা করা। সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্য নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করা। সংগঠনটি তরুণীদের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে এবং এই শিল্পে উদ্যোগী হতে উৎসাহিত করে থাকে। নারী উদ্যোক্তা এবং পেশাজীবীদের আইসিটিতে সাফল্য অর্জনের জন্য নেতৃত্ব গুণাবলীসহ অন্যান্য দক্ষতা বাড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টাও করা হয় এই সংগঠনের পক্ষ থেকে। কাজেই যে নারীরা বাংলাদেশের আইসিটি খাতের সঙ্গে যুক্ত তারা খুব সহজেই বিডব্লিউআইটির সদস্য হতে পারেন।
সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কোনো জোরালো ভূমিকা নেই। এই খাতে নারীরা যে পিছিয়ে পড়ছেন এ জন্য যে পরিমাণ জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন, তা দেখা যাচ্ছে না। দেখা যায়, দেশে কারিগরি জ্ঞান প্রশিক্ষণ দেয় যেসব প্রতিষ্ঠান আছেÑ সেখানে পুরুষের সমানতালে নারীরাও আসছেন না। এর জন্য সরকার পক্ষ কিংবা বিভিন্ন এনজিও যারা নারী উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে এমন অনেক সংস্থা বাংলাদেশে আছে। তারা নারীদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীদের পুরুষের পাশাপাশি এগিয়ে আসার জন্য কাজ একেবারেই কম। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অল্পশিক্ষিত নারীরা স্বল্প কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন কাজে সাফল্য পাচ্ছেন। নারীর পূর্ণ ক্ষমতায়ন প্রযুক্তি জ্ঞান ছাড়া সম্ভব নয়। এ জন্য আইসিটি খাতে নারীদের এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে আইন করে হলেও আইসিটিতে নারীদের এগিয়ে আসা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এই বিশাল জনশক্তিকে প্রযুক্তির জ্ঞানে দীক্ষিত করতে পারলে তারা আমাদের বোঝা হবে না, হবে দেশের সম্পদ। আমাদের দেশে অনেক নারী ঘর থেকে বের হতে চান না। তাদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিয়ে ইন্টারনেটে নিজের ঘরে বসে আউট সোর্সিং ফ্রিল্যান্সিং করে দেশি-বিদেশি প্রচুর মুদ্রা অর্জন করতে পারবেন। স্বল্প শিক্ষিত নারীদের সামান্য প্রশিক্ষণ দিতে পারলে ভালো সফলতা পাওয়া যাবে।
আমাদের দেশের অনেক নারী আছেন, যারা ঘরের বাইরে গিয়ে চাকরি করতে পারছেন না। কিন্তু তারা স্বাবলম্বী হতে চান। সেদিক থেকে ই-কমার্সের মাধ্যমে তারা ঘরে বসে ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। ই-কমার্সের সুবিধা হলো- অল্প পুঁজিতে এমনকি বিনা পুঁজিতেও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াই ব্যবসা করা যায়। ই-কমার্স মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়ার অন্যতম মাধ্যম। বাংলাদেশের নারীদের ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ই-কমার্স। এই সেক্টরে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তা আমাদের দেশের জন্য অবশ্যই ইতিবাচক।