বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : সরকারি উদ্যোগ থাকার পরও উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরে শিশুশ্রম রয়ে গেছে

172

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
সরকারি উদ্যোগ থাকার পরও উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরে শিশুশ্রম রয়ে গেছে
ঢাকা, ৭ আগস্ট, ২০১৮ (বাসস) : আজকের শিশুই জাতির আগামী দিনের ভবিষ্যত। তারাই একদিন সমাজের কান্ডারি হবে, এমনকি দেশও পরিচালনা করবে। সুতরাং তারা যদি সুন্দর ও সঠিকভাবে বেড়ে না উঠতে না পারে পারে তা হবে জাতির জন্য অকল্যাণকর।
বাস্তবতা হচ্ছে অনেক শিশুই বেড়ে উঠছে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে। বিশেষ করে শিশু বয়সে তারা শ্রমে জড়িয়ে পড়ছে। এতে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবার লেখাপড়া থেকে ছিটকেও পড়ছে। আর লেখাপড়া করলেও তারা বেশিদূর এগোতে পারে না। শিক্ষার জগত থেকে ঝরে পড়ে। এ ঝরে পড়ার কারণ হিসেবে জানা যায়, শিশুর পারিবারিক দারিদ্র্যতা, পিতৃ-মাতৃহীনতা ও বাবা-মায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিচ্ছেদ অন্যতম। এমন অবস্থায় শিশুর জীবন নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়ে। আর এ কারণে তারা শ্রমে নিয়োজিত হতে বাধ্য হয়।
বিভিন্ন তথ্যানুযায়ী জানা যায়, দেশে এমন শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৭৯ লাখ। এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৬৪ লাখ। শহরে ১৫ লাখ। এ শিশু শ্রমিকদের মধ্যে ৪৫ লাখ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এর মধ্যে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে ১৩ লাখ। এত বেশি সংখ্যক শিশু শ্রমিক একটি জাতির জন্য হতাশাজনক চিত্র।
শিশুশ্রমের এ হতাশাজনক চিত্র দেশের উপকূলীয় এলাকায় বেশি দৃশ্যমান। দেশের ১৮টি জেলার ১৩৭টি উপজেলা উপকূলীয় এলাকা। এখানে মানুষের বসবাস ৪ কোটি ৬০ লাখ। দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে এখানে দারিদ্র্য বেশি। নদী ভাঙ্গন, বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। তাই এখানকার মানুষের জীবন নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়ে। অভাব তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। এসব পরিবারে শিশুরা কম বয়সে শ্রম বিক্রি করে বাঁচার তাগিদে। শ্রম দিতে গিয়ে তারা নানা রকমের নির্যাতনের শিকার হয়। এসব খবরও সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
যেমন,কয়েক মাস আগে লক্ষ্মীপুরে সোহেল নামের এক ১০ বছরের শিশুকে গাছে বেঁধে নির্যাতনের খবর প্রকাশ পেয়েছে পত্রিকায়। সোহেল সদর উপজেলার কুশাখালির বাসিন্দা শহিদুল হোসেনের ছেলে। সে স্থানীয় মান্দারী বাজারে বাবুলের চায়ের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো। বাবুল সকালে বাড়ি থেকে চায়ের দোকানে আসার সময় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে একটি বাগানে মলত্যাগ করে। এজন্য বাগানের মালিক তাকে ধরে নিয়ে গাছের সাথে বেঁধে লাঠি ও ঝাড়– দিয়ে বেধড়ক পেটায়। বিকেলে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় শিশুটিকে উদ্ধার করে চিকিৎসা দেয়া হয়। এ রকম নানা ভাবে নির্যাতনের শিকার হয় শিশু শ্রমিকরা।
উপকূলীয় এলাকায় শিশুরা চায়ের দোকান ছাড়াও সবজি চাষে, মুরগির খামারে, গরু-ছাগল পালনে ও মাছ ধরায় শ্রম দেয়। এমনকি তাদের ইট ভাটায়, লোহালক্কড়ের কারখানায় কঠিন কাজও করতে দেখা যায়।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় মজু চৌধুরীহাট ঘাটে মেঘনা নদীর পাড়ে কয়েকশ’ বেদে পরিবার। তাদের বসবাস নদীতে। সেখানকার শিশুরা বাবার সাথে মাছ ধরে। রামগতি উপজেলার চরগজারিয়ার মানুষেরা মৎস্যজীবী। সেখানকার শিশুরা বাবার সাথে মাছ ধরতে যায়।
লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল ওয়াহেদ জানান, উপকূলীয় এলাকার চরাঞ্চলে শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। যেখানে দারিদ্র্য বেশি, সেখানে শিশুশ্রমও বেশি। তাই এসব এলাকার শিশু শ্রমিক বেশি। তারা স্কুলমুখী হয় না। স্কুলে গেলে এখন খাবার দেয়া হয়, উপবৃত্তি দেয়া হয়। এগুলো দেয়ার পরও লেখাপড়ায় তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না। শিশুশ্রমের মাধ্যমে নগদ পাওনাটাই বেশি করে দেখে। রায়পুর, কমলনগর ও রামগতিতে শিশুরা মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত। বাবা-মায়ের সচেতনতার অভাবে তারা শ্রম দেয়। তাদের ধারণা, বাপ-দাদা এবং নিজেরা মাছ ধরা পেশায় আছে এজন্য তাদের ছেলেরাও মাছ ধরে জীবন নির্বাহ করবে। তাই শিশুশ্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না। শিশুশ্রমের এ চিত্র ও পরিবেশ শুধু লক্ষ্মীপুরে নয়, সাড়া উপকূলীয় এলাকায় তা দেখা যাবে।
জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক আইয়ুব খান জানান, এ জেলায় শিশু শ্রমিক কতজন, তারা কি কাজ করে, সে সম্পর্কে কোন তথ্য তাদের কাছে নেই। শিশুশ্রম বন্ধে কোন এনজিও কাজ করলে তাদের দফতরে তারা অবহিত করতো। ধারণা করা যায়, শিশুশ্রম প্রতিরোধে কোন এনজিও সেখানে কাজ করছে না।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ বছর পর্যন্ত সবাই শিশু। ১৮ বছরের মধ্যে কাজে নিয়োগ করা যাবে না। তবে সংস্থার শিশু আইনের বিভিন্ন ধারায় কাজের ধরনের ক্ষেত্রে শিশুর বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ১৬ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত কিছু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারবে। ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সে হালকা পরিশ্রমের কাজ করতে পারবে। অন্যদিকে ১৯৭৪ সালে শিশু আইনে ১৬ বছর পর্যন্ত একজনকে শিশু হিসেবে ধরা হয়েছে। আবার জাতীয় শিশু নীতিতে ১৪ বছর বয়সের কাউকে শিশু হিসেবে গণ্য করার বিধান রাখা হয়েছে। আইনে শূন্য থেকে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের সব শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ৫ বছর পর শিশুরা বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হয়। এমনকি তারা শ্রমকঠিন কাজ ইটভাটায়, নির্মাণ কাজে, মোটর ওয়ার্কশপে, জাহাজ শিল্পে, ওয়েল্ডিং কারখানায় কাজ করছে।
সরকার দেশে শিশুশ্রম বন্ধে সবধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিশুশ্রম আইন-২০১০ প্রণয়ন করেছে। এতে বলা হয়েছে, ১৮ বছরের নিচে কোন শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ দেয়া যাবে না। নিয়োগ দিলে তা হবে দন্ডনীয় অপরাধ।
২০২১ সালের মধ্যে শিশুশ্রম বন্ধের লক্ষ্যে নানা রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন, লক্ষ্মীপুরে ১৭৫ জন অনাথ শিশুদের জন্য থাকা-খাওয়া ও লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। এ শিশুরা অনাথ আশ্রমে আশ্রয় না পেলে জীবন বাঁচাতে তারা শ্রম দিতো। লক্ষ্মীপুরের মতো প্রায় প্রতিটি জেলায় এ ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতির মাধ্যমে দেশের রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও খুলনায় ৩টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র গড়ে তেলা হয়েছে। তৈরি পোশাক কারখানায় শিশুশ্রম বন্ধের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পোশাক রফতানি সমিতি, ইউনিসেফ ও আন্তর্জাতকি শ্রম সংস্থার উদ্যোগে ৪২ হাজার শিশু শ্রমিককে তৈরি পোশাক কারখানা থেকে বের করে এনে লেখাপড়া ও প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কাজে সুযোগ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে তৈরি পোশাক কারখানায় শিশুশ্রম নেই।
সরকারের সদিচ্ছা ও উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও শিশুশ্রম রয়ে গেছে। ভবিষ্যতের নাগরিকরা জীবনের প্রারম্ভে শ্রমে আত্মনিয়োগ করে ভবিষ্যত জীবনকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। তাই শিশুশ্রম বন্ধ করা জরুরি। এজন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি মানুষকে আরো সচেতন হতে হবে। এছাড়া উপকূলীয় এলাকার পশ্চাৎপদ মানুষদের সহযোগিতায় হাত বাড়িয়ে দিতে বিত্তবান ও বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে, যাতে সেখানকার শিশুরা শ্রমে জড়িয়ে পড়তে না পারে।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/মরপা/স্বব/১৯০৫/আহো/ওজি