জাতির জনকের জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ জ্বালনি খাত, পথ দেখিয়ে গেছেন তিনি

316

॥ অরুণ কর্মকার ॥
ঢাকা, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ (বাসস): বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার জন্য খুব কম সময়ই পেয়েছেন। কিন্তু তার মধ্যেই তিনি এমন কিছু মৌলিক কাজ করে গেছেন যা বাংলাদেশের ভিত্তি শক্ত করেছে। দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যও তাঁর পদক্ষেপ ছিল তেমনই এক মৌলিক কাজ।
সরকারি উদ্যোগে ২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর ৯ আগস্ট পালিত হয়ে আসছে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস। সেই সুবাদে এখন সবাই জানে যে, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট, তাঁর সপরিবারে নৃশংস হত্যাকান্ডের মাত্র ছয়দিন আগে শেল অয়েল কোম্পানির কাছ থেকে ৫টি গ্যাস ক্ষেত্রের শতভাগ মালিকানা কিনে রেখেছিলেন, মাত্র ৪৫ লাখ (সাড়ে চার মিলিয়ন) পাউন্ডে।
দেশের সেই ক্রান্তিকালেও তিনি এই সাহসী ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ, তিনি বুঝেছিলেন, জ্বালানি ছাড়া উন্নয়নের চাকা ঘুরবে না। আর নিজেদের জ্বালানি সম্পদ আহরণ ও তার ব্যবহার বাড়ানো ছাড়া জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না।
সেদিন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে যে ৫টি গ্যাস ক্ষেত্রের শতভাগ মালিক বানিয়েছিলেন সেগুলো হলো- তিতাস, বাখরাবাদ, হবিগঞ্জ, কৈলাশটিলা ও রশিদপুর গ্যাস ক্ষেত্র। তখন ওই ৫টি ক্ষেত্রে গ্যাসের মোট মজুত (গ্যাস ইন প্লেস) ছিল প্রায় ২১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। এর মধ্যে উত্তোলনযোগ্য মজুত ছিল সাড়ে ১৫ টিসিএফ। এখনো প্রতিদিন দেশে যে পরিমান গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে তার প্রায় ৩৫ শতাংশ আসছে এই ৫টি ক্ষেত্র থেকে। এই ক্ষেত্রগুলোতে এখনো প্রায় ৬ টিসিএফ গ্যাস মজুত আছে যার দাম প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা।
তবে, খুব সহজে তিনি ওই গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মালিকানা পাননি। বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন একান্ত সচিব ড. ফরাস উদ্দিন ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্টের স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, সেদিন ছিল শনিবার। বঙ্গবন্ধু অফিসে এসে বললেন, আজ আমি বাঙালির একটি মুক্তির সনদে সই করবো। তার কিছুক্ষণ পরেই ওই ৫টি গ্যাসক্ষেত্রের মালিকানা সংক্রান্ত দলিলপত্রে স্বাক্ষর করেন তিনি।
ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মালিকানা ছাড়তে শেল কোম্পানি রাজি হচ্ছিল না। তখন বঙ্গবন্ধু তাঁদের প্রতিনিধিকে ডেকে এনে বলেছিলেন, তোমরা যদি মালিকানা হস্তান্তর করতে রাজি না হও তাহলে আমরা দেশের নতুন আইন অনুযায়ী ক্ষেত্রগুলো বাজেয়াপ্ত করতে পারি। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৬ এবং ৪৩ অনুচ্ছেদ আমাদেরকে সেই অধিকার দিয়েছে। এরপর শেল কোম্পানি মালিকানা হস্তাস্তরে রাজি হয়।
এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান পেট্রোলিয়ামের মালিকানাধীন সিলেট অঞ্চলের দুটি গ্যাস ক্ষেত্র জাতীয়করণ করেছিলেন। আজ আমরা ভেবে দেখতে পারি যে, বঙ্গবন্ধু সেদিন ওই গ্যাস ক্ষেত্রগুলো কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত না নিলে দেশের জ্বালানি খাতের অবস্থা কী হতো!
দেশের নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ আহরণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে আরও অনেক উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। তারও আগে স্বাধীন দেশে জ্বালানি তেলের সুষ্ঠু সরবরাহ ও বিপনন নিশ্চিত করার জন্য তিনি তেল বিপননকারী তিনটি কোম্পানি-পদ্মা, মেঘনা ও যমুনাকে জাতীয়করণ করেন। এর ফলে ওই সময়ের প্রধান এবং বলতে গেলে একমাত্র বাণিজ্যিক জ্বালানি পণ্যের সুষ্ঠু সরবরাহ ও বিপনন নিশ্চিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ওই পদক্ষেপে একইসঙ্গে আজকের বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) ভিত্তি স্থাপিত হয়। সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই বিপিসি আজ অনেক বড় একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে।
গ্যাস খাতকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু স্থলভাগে এবং বঙ্গোপসাগরে জ্বালানি অনুসন্ধানের পদক্ষেপ নেন। নিজেদের সামর্থ্য সীমিত হওয়ায় স্থলভাগে অনুসন্ধানের জন্য তিনি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি করেন। তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক পশ্চিম জার্মানীর কাছেও তিনি সহায়তা চেয়েছিলেন। পশ্চিম জার্মানী বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দীর্ঘদিন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পরও বাংলাদেশে কাজ করেছে।
সদ্য স্বাধীন দেশের জ্বালানি খাতকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু তেল, গ্যাস ও খনিজ করপোরেশন (বর্তমান পেট্রোবাংলা) প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠা করেন মিনারেল এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান দুটি যাতে স্বাধীনভাবে দ্রুততার সঙ্গে মানসম্পন্ন ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে ও কাজ করতে পারে সেই জন্য তিনি এই দুটি প্রতিষ্ঠানে সচিব র্মযাদার চেয়ারম্যান নিয়োগ করেন।
তিনি পেট্রোলিয়াম আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করেন যা তাঁর হত্যাকান্ডের পর অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয় এবং ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে আইন হিসেবে পাস হয়। জ্বালানি খাতে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার জন্য তিনি এই খাতের কর্মকর্তাদের জ্বালানি সম্পদে সমৃদ্ধ ইন্দোনেশিয়া ও আলজেরিয়ায় প্রশিক্ষণের জন্য পাঠাতে শুরু করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ভূতাত্ত্বিক জরিপের কাজ বেগবান করার উদ্যোগ নেন। ভারতের সহায়তায় তিনি জামালগঞ্জ কয়লাখনি উন্নয়নের পদক্ষেপ নেন। জয়পুরহাটের চুনাপাথর খনি উন্নয়নের জন্যও তিনি উদ্যোগ নেন। মধ্যপাড়া কঠিনশিলা খনি উন্নয়নের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই করা হয়।
দেশের সমুদ্রসীমায় জ্বালানি সম্পদ আহরণের জন্য বঙ্গবন্ধু জাতীয় সংসদে মেরিটাইম অ্যাক্ট বিল পাস করেন। তখন র্পযন্ত পৃথিবীর খুব কম দেশেই এমন আইন ছিল। গভীর সমুদ্রে জ্বালানি অনুসন্ধানের জন্য ‘প্রোডাকশন শেয়ারিং কনট্র্রাক্ট (পিএসসি) ফর ডিপ সী এক্সপ্লোরেশন’ প্রণয়ন করেন। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু ৮টি বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে মোট ৩১ হাজার ৬০০ লাইন কিলোমিটার ভূকম্পন জরিপের কাজ করান। এর অংশ হিসেবে তখন অগভীর সমুদ্রবক্ষে ৭টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়। তখনই কুতুবদিয়া গ্যাসক্ষেত্রটি আবিস্কৃত হয়। যদিও আজ অবধি সেখান থেকে গ্যাস তোলা হয়নি।
এই সব উদ্যোগ ও পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশকে জ্বালানি খাতে স্বনির্ভর হওয়ার পথ দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু তাঁর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর দেশের উন্নয়নমুখী সব উদ্যোগই থেমে যায়। রাজনৈতিক বিশৃংখলা, সামরিক অভ্যূত্থান-পাল্টা অভ্যূত্থানে ক্ষমতা দখলের লড়াই বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশকে একটি বিভ্রান্ত ও লক্ষ্যহীন রাষ্ট্রে পরিণত করে। উন্নয়নের অগ্রযাত্রার পরিবর্তে বাংলাদেশ স্বাধীনতার চেতনার বিপরীতে চলতে শুরু করে। নব্বইয়ের দশকে কিছুটা স্থিতাবস্থা ফিরে এলে জ্বালানি খাতেও কিছু র্কাযক্রম শুরু হয়।
তবে, বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে ওঠে ২০০৯ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর। ওই সময় প্রায় সব ক্ষেত্রে নতুন উদ্যমে দেশের অগ্রযাত্রা সূচিত হয় যা অব্যাহত আছে। জ্বালানি খাতও এগিয়ে চলেছে সমান তালে।
২০১১ সালের মধ্যভাগে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত বিরোধ মিমাংসার পর তেল-গ্যাস অনুন্ধানের জন্য সমুদ্র অঞ্চলকে মোট ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি অগভীর সমুদ্রে যার সম্মিলিত আয়তন প্রায় ৫৮ লাখ ৭২৯ বর্গ কিলোমিটার। আর ১৫টি গভীর সমুদ্রে যার মোট আয়তন প্রায় ৫২ হাজার ৩৯৭ বর্গ কিলোমিটার।
এই ২৬টির মধ্যে বর্তমানে ৪টি ব্লকে ৪টি উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তির (পিএসসি) অধীনে মোট ৫টি বিদেশি কোম্পানি কাজ করছে। ব্লকে ৪টির মধ্যে তিনটি অগভীর ও একটি গভীর সমুদ্রের।
গত ১০ বছরে দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে প্রাকৃতিক গ্যাসের দৈনিক উত্তোলন ও সরবরাহ ১৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে বেড়ে প্রায় ২৭৫০ মিলিয়ন হয়েছে। শিগগিরিই আরও একটি নতুন কূপ (শ্রীকাইল পূর্ব-১) থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে। উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি পাওয়ায় জ্বালানির চাহিদা বেড়েই চলেছে। এই বর্ধিত চাহিদা মিটানোর জন্য এলএনজি আমদানি শুরু করা হয়েছে। যার ফলে দেশের উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে।
জ্বালানি তেলের বার্ষিক আমদানি ৬০ লক্ষ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে এবং প্রতি বছর এই চাহিদা নির্দিষ্ট হারে বাড়ছে যার অর্থ হচ্ছে অনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি।
সারাদেশের আবাসিক গ্রাহকদের দৈনন্দিন জ্বালানি চাহিদা মিটানোর লক্ষ্যে এলপি গ্যাস আমদানি ও সরবরাহ ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। ব্যক্তিগত গাড়িতেও এলপি গ্যাসের (অটো গ্যাস) ব্যবহার বাড়ছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি মিশ্রন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কয়লাভিত্তিক বড় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে (পায়রা) চালু হয়েছে। আরও অন্তত দুটি স্থাপনের কাজ চলেছে। পাবনার রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলেছে।
সরকার এই যে তেল, গ্যাস, কয়লাভিত্তিক থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র র্পযন্ত স্থাপনের একটি সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে, এর একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। স্বাধীনতা পরবর্তী ভঙ্গুর ও বিশৃংখল আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সেই পথে হেঁটেছিলেন। বাংলাদেশের প্রকৃত উন্নতির পথ সেটাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ সেই পথ অনুসরণ করেই এগিয়ে চলেছে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ।