শিশুর অটিজম রুখতে শুরুতেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে

2556

ঢাকা, ২৯ আগস্ট, ২০২০(বাসস): রাতুলের (ছদ্মনাম) বয়স তিন বছর দুই মাস। কিন্তু এখনো সে ঠিকমত দাঁড়াতে পারে না। আবার ঠিকমত কথাও বলতে পারেনা। কয়েকটি শব্দ উচ্চারন করলেও পুরো কোন বাক্য বলতে পারেনা। এমনকি কারো দিকে খুব একটা তাকায়ও না। সবমসয় একা থাকতে পছন্দ করে। কারো সাথে তেমন মিশতে চায়না। এমনকি অন্য বাচ্চাদের সাথেও মিশতে বা খেলতে চায়না। কোন একটা জিনিস চাইলে সেটা বারবার চাইতে থাকে। যতক্ষণ না পাবে, ততক্ষণ চাইতে থাকবে আর কান্না করতে থাকবে।
রাতুলের মধ্যে থাকা বৈশিষ্ঠ্য অটিজমের। অর্থাৎ রাতুল একজন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু। অটিজম হচ্ছে স্নায়ুর বিকাশ জনিত সমস্যা। মায়ের গর্ভ থেকে জন্মের কয়েক বছর পর পর্যন্ত শিশুর ¯œায়ুতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে থাকে। কোনো কারণে ¯œায়ুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতে পারে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এর সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ হেলাল বলেন প্রতিটি শিশুকেই তার জন্মের পর থেকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যদি দেখা যায়- ছয় মাস বয়সের মধ্যে শিশু একা একা না হাসে, বার মাস বা এক বছর বয়সের মধ্যে আধো আধো বোল বলতে পারছে না, পছন্দের বস্তুর দিকে ইশারা করছে না, ১৬ মাসের মধ্যে কোনো একটি শব্দ বলতে পারে না, ২৪ মাস বয়সের মধ্যে দুই বা ততোধিক শব্দ দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না, ভাষার ব্যবহার রপ্ত করতে পারার পর আবার ভুলে যাচ্ছে, বয়স উপযোগী সামাজিক আচরণ করছে না- এসব লক্ষণ দেখা গেলে তখন তাকে অবশ্যই অটিজমের বৈশিষ্ট্য আছে কি না, বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, অটিজম রয়েছে এমন শিশুর মধ্যে মূলত দুই ধরনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়: প্রথমত সামাজিক সম্পর্ক তৈরিতে অসুবিধা এবং আশপাশের পরিবেশ ও ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের সমস্যা এবং দ্বিতীয়ত বারবার একই ধরনের আচরণ করা।
তিনি বলেন, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি বা শিশুরা সামাজিকতা পালন করতে পারে না, নিজের আগ্রহ, আবেগ আর অনুভূতি অপরের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না, যেকোনো ধরনের সামাজিক সম্পর্ক শুরু করার জন্য নিজে থেকে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে না এবং যদি সে কথা বলতেও পারে, তবু আরেক জনের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়। কেউ কেউ ঠিকমতো কথা বলতে পারে না বা একেবারেই কোনো অর্থবোধক শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না। নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না, চোখে চোখ রেখে তাকায় না এবং পরিবেশ অনুযায়ী মুখভঙ্গির পরিবর্তন করে না, অর্থাৎ ভয় পেলে বা খুশি হলে মুখ দেখে বোঝা যায় না। অটিজম আছে এমন শিশুরা কল্পনা করে খেলে না।
হেলাল বলেন, একই ধরনের আচরণ এ ধরনের শিশুরা বারবার করতে পারে। যেমন হাতে তালি দেওয়া, মেঝেতে ঘুরতে থাকা, বারবার আঙ্গুলের সঙ্গে আঙ্গুল প্যাঁচানো। কখনো একটি বস্তুকে বারবার একই ভাবে ব্যবহার করা। যেমন খেলনা গাড়ির চাকা বারবার ঘোরানো, কখনোবা একই শব্দ বারবার উচ্চারণ করা। অটিজম আছে এমন যারা কথা বলতে পারে, তারা দেখা যায় একই প্রশ্ন বারবার করছে বা প্রশ্নকর্তার প্রশ্নটিই বারবার উচ্চারণ করছে। এই ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা রুটিন বা প্যাটার্ন মেনে চলতে পছন্দ করে, রুটিনের ব্যতিক্রম হলে রেগে যায় বা মন খারাপ করে।
সাধারণত শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশের পর্যায়ে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১৮ মাস থেকে ৩৮ মাস বয়সের মধ্যেই) অটিজমের বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পায়।
অটিজমের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে কিছু বিষয়কে অটিজমের ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন: বংশে কারও অটিজমের সমস্যা, মায়ের গর্ভকালীন সংক্রমণ, জন্মের সময় শিশুর ওজন কম থাকা, গর্ভকালীন সময়ে বিষাক্ত শিসাযুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়া, প্রসবকালীন কোনো জটিলতা, মা ও শিশুর অপুষ্টিজনিত সমস্যা।
অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের মধ্যে খিঁচুনি (মৃগী), অতিচঞ্চলতা (হাইপার অ্যাক্টিভিটি), বুদ্ধির ঘাটতি, হাতের কাজ করতে জটিলতা, হজমের সমস্যা, দাঁতের সমস্যা, খাবার চিবিয়ে না খাওয়া ইত্যাদি সমস্যা থাকতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) পরিচালিত সর্বশেষ জরিপ (২০১৮ সালে প্রকাশিত) অনুযায়ী দেখা যায়, প্রতি ৫৯ জন শিশুর মধ্যে ১ জনের অটিজম রয়েছে। মেয়ে শিশুদের তুলনায় ছেলে শিশুদের অটিজমের বৈশিষ্ট্য থাকার আশংকা প্রায় ৪ গুণ বেশি। বিগত ৪০ বছরে সারা বিশ্বে অটিজমের হার বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। এর মূল কারণ, বারবার অটিজমের সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়েছে, ফলে অটিজমের বৈশিষ্ট্যের পরিধি বেড়েছে।
হেলাল বলেন, বিগত কয়েক বছরে বিশেষ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে অটিজম নিয়ে সচেতনতা বহুগুণ বেড়েছে। আগের চাইতে অনেক বেশি অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা শনাক্ত হচ্ছে এবং সঠিক পরিচর্যা ও সেবা পাচ্ছে। কিন্তু এরপরও অটিজম নিয়ে রয়ে গেছে কিছু ভ্রান্ত ধারণা। সবার আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ এবং উপদেশ মেনে নিতে হবে। এরপর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পরিচর্যা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ আর প্রয়োজনে বিশেষ কিছু সমস্যার ওষুধ সেবন করতে হবে। অটিজম আছে এমন শিশুদের আচরণ জনিত সমস্যা, অতিচঞ্চলতা, অস্থিরতা, নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা, খিঁচুনি বা খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদির জন্য প্রথিবীর সব উন্নত দেশেই সীমিত আকারে ওষুধের প্রয়োগ রয়েছে। এই ওষুধ তাকে প্রশিক্ষণের উপযোগী করে তুলবে এবং সহযোগী সমস্যাগুলো কমাবে। তবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাওয়াতে হবে।