বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে খাদ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্র বিনির্মাণ কৌশল গ্রহণ করেছিলেন

696

॥ এ কে এম কামাল উদ্দিন চৌধুরী ॥
ঢাকা, ১২ আগস্ট, ২০২০ (বাসস): যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হিসেবে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের লক্ষ্য নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জনগণকে একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনে সক্ষমতা দানের জন্য খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ক্ষতিগ্রস্থ যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনর্গঠনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সফলভাবে একটি রাষ্ট্র বিনির্মান কৌশল গ্রহন করেছিলেন।
ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি বাস্তবায়নের একটি দীর্ঘ মেয়াদী অর্থনৈতিক প্রয়াসের পরিকল্পনা গ্রহন করেন।
পাকিস্তানে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অর্থনীতি পুনর্গঠন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি এক্ষেত্রে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান।
দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিতে একটি ক্ষুধা ও দরিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে বঙ্গবন্ধু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও খাদ্য উৎপাদনের উপর প্রাধান্য দেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরনিকায় জুলিয়ান ফ্রান্সিস তার ‘থিংকিং অ্যাবাউট অ্যান্ড রিমেম্বারিং বঙ্গবন্ধু’ আর্টিকেলে লিখেন ‘তখন খাদ্য উৎপাদন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সংস্কার করাই ছিল সবচেয়ে জরুরি। এই দুটির প্রয়োজনীয়তা ছিল সবচেয়ে বেশি। কারণ দেশের বিভিন্ন স্থানে খাদ্য সরবরাহে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ছিল অপরিহার্য। এটা লক্ষণীয় যে বঙ্গবন্ধু প্রশাসন শরণার্থীদের খুবই সুশৃঙ্খলভাবে দেশে ফিরিয়ে আনে।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি এই স্মারক গ্রন্থটি প্রকাশ করে।
সুনামধন্য ব্রিটিশ এনজিও অক্সফাম এর সাবেক কর্মকর্তা জুলিয়ান ফ্রান্সিস ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী হানাদারদের ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় গ্রহনকারী বাংলাদেশী শরণার্থীদের মাঝে কাজ করেন।
তিনি বলেন, তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্মম বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে অবগত।
তিনি আরো বলেন, ‘পরে ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় শরণার্থী শিবিরগুলোতে আমি অক্সফামের ব্যাপক ত্রাণ কর্মকা-ে যুক্ত ছিলাম। সেই সময়ে ৬ লাখ বাংলাদেশী নারী, পুরুষ ও শিশুকে ত্রাণ দেয়া হচ্ছিল।’
ফ্রান্সিস বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি বাংলাদেশে আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। ১৯৭১ সালে ভারতে নির্বাসিত বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এ সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে ফ্রান্সিসের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন।
তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন যে, অক্সফামের মতো ছোট সংগঠন বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও উন্নয়নে কি ধরনের সাহায্য করতে পারে সে সম্পর্কে তিনি বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ চান।
ফ্রান্সিস বলেন, তখন বঙ্গবন্ধু তাঁর মুখ থেকে পাইপ সরিয়ে আমার দিকে ধোঁয়া ছেড়ে বলেন, ‘হে যুবক আপনি কিভাবে এখানে এলেন?’ আমি তাঁকে বললাম যে, আমি কোলকাতা থেকে সড়কপথে এখানে এসেছি। তখন তিনি বললেন, ‘আপনি তাহলে আমার চেয়ে বেশি এই দেশকে দেখেছেন। কারণ নয় মাস আমি কারাগারে আটক ছিলাম। তাই দয়া করে আপনিই আমাকে বলুন আমার দেশের কি প্রয়োজন? আপনি কি দেখলেন?’
ফ্রান্সিস বলেন, বঙ্গবন্ধুর সাথে ওই বৈঠকের পর অক্সফাম তিনটি ট্রাকবাহী ফেরি সংগ্রহ করে নিয়ে এলো এবং আরো অনেকগুলো মেরামতে সহায়তা করল।
আর্টিকেলটিতে জুলিয়ান ফ্রান্সিস আরো উল্লেখ করেন যে, ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার ভাইয়েরা, আপনারা জানেন যে আপনাদের অনেক কাজ করতে হবে। আমি চাই আমার সব মানুষ ভেঙ্গে পড়া পথঘাট সংস্কারে কাজ শুরু করুক। আমি চাই আপনারা সবাই ধান চাষ করতে ক্ষেতে ফিরে যান। আমি বলতে চাই, একজন কর্মচারীও যেন ঘুষ না খায়। মনে রাখবেন, ঘুষখোরদের আমি কখনোই ক্ষমা করব না।’
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারি সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবার স্মরণ করিয়ে দেন যে, তাদেরকে দেশ ও জনগণের সেবায় উৎসর্গ করতে হবে।
ফ্রান্সিস বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, তারা জনগণের সেবক, মালিক নয়। তিনি তাদেরকে এয়ার কন্ডিশনার, কার্পেট ও বিলাসজাত কোন জিনিস না কেনার নির্দেশ দেন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, দেশের প্রথম জাতীয় বাজেটেও কৃষি, শিক্ষা এবং মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে যেসব নারী, শিশু ও অন্যান্যরা বাড়িঘর হারিয়েছে তাদের জন্য বাড়িঘর নির্মাণসহ সমাজ কল্যাণমূলক কার্যক্রমের উপর প্রাধান্য দেয়া হয়।
তিনি আরো বলেন, দারিদ্র দূরীকরণ ও সকলের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও বাসস্থান নিশ্চিতের লক্ষে বঙ্গবন্ধু দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
আতিউর বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সব সময়ই গরিবদের জন্য কাজ করতেন। এমনকি শিশুকাল থেকেই তার বাবার গোলার শস্য তাঁর গরিব প্রতিবেশীদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন।’
তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু কর্মসংস্থার সৃষ্টির লক্ষ্যে ও আয়-বৈষম্য হ্রাসের জন্য কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এসএমইএস এবং কুটির শিল্পের উপর গুরুত্ব দিতেন।
আতিউর রহমান বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার মানুষকে পুনরায় যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে কিছু বড় সেতু, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ মেরামত শুরু করে। এগুলো দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
তিনি আরো বলেন, পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, তিস্তা রেল সেতু ও ভৈরব রেল সেতুর সংস্কার করা হয় এবং যান চলাচলের জন্য এগুলোকে খুলে দেয়া হয়। এছাড়াও মাইন ও জাহাজের ধ্বংসস্তুপ অপসারণ করে চট্টগ্রাম বন্দরও পুনরায় খুলে দেয়া হয়।
১৯৭২ সালে জাতিসংঘের ত্রাণ পরিচালনা দল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের পর এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ একটি সুশৃঙ্খল দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণেই এমনটি সম্ভব হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছিল, মার্কিন দূতাবাস থেকেও বলা হয় যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী (বঙ্গবন্ধু) সবকিছু তাঁর নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। তিনি সুশৃঙ্খল উপায়ে তাঁর প্রশাসনকে সাজাতে পেরেছেন। অনেকেই ভাবতে পারেনি যে, এক বছর আগেও বাংলাদেশের অস্তিত্ব ছিল না।