স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন একজন অন্যরকম মা হাজেরা বেগম

1033

ঢাকা, ২৭ জুলাই, ২০১৮(বাসস) : নিজের জীবনের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নকে বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন ৪৭ বছর বয়সী হাজেরা বেগম। পেশায় ছিলেন যৌনকর্মী। হয়ে উঠলেন যৌনকর্মীদের অবাঞ্ছিত সন্তানের মা। সমাজে তাদের স্বীকৃতি দিলেন, সমাজের মূল ধারায় এসব শিশুদের সম্পৃক্ত করতে যোগ্য করে গড়ে তুলছেন। এসব শিশুরা বিভিন্ন বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে রাখছে মেধার স্বাক্ষর।
হাজেরার এপর্যন্ত সন্তানের সংখ্যা প্রায় ১৫০ জন। এসব সন্তানেরা জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার লড়াইয়ে কাজ করে গেলেও মাকে ভোলে না। নিয়ম করে তারা এ পরিবারে আসে এবং সময় কাটিয়ে ফিরে যায় নিজের কর্মস্থলে কেউ কেউ তার স্নেহেই প্রতিপালিত হচ্ছে।
এসব সন্তান তার ঔরসজাত নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে যৌনকর্মীরা তাদের সন্তানকে নির্ভরতার আশ্রয় হিসেবে তার কাছে রেখে যান। মাসিক আর্থিক খরচ দেয়ার কথা থাকলেও অনেকে আর খোঁজ খবর রাখে না। নি:সন্তান এই নারীকে আশ্রিত শিশুরা যখন ‘মা’ ডাকে তখন তিনি সব কষ্ট ভুলে সকলকে নিয়ে মিলেমিশে থাকেন।
হাজেরার জীবনের গল্প আর পাঁচ জনের মতো নয়, সৎ মায়ের সংসারে মানুষ। ক্ষুধার যন্ত্রণা নিয়েই ঘর পালায় ৭ বছরের হাজেরা। মীরপুরের বাস্তুহারা বস্তি থেকে পালিয়ে বাসে উঠেছিলেন। বাসেই ঘুমিয়ে পড়ে,জানতে পারেন গুলিস্তান এটি। ঠিকানা বলতে না পারায় ফিরে যাওয়া হয়না পরিবারের কাছে। ময়লা-আবর্জনা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসপত্র ভাঙ্গারী দোকানে বিক্রি আর জীবন চলতে থাকে তার জীবন। জিপিও এ সামনে থেকে ‘মাড় ভাত’ খেয়ে টিকে থাকা হাজেরা সেসময় জেলে বাবার খোঁজ আর পায়নি ভেসে বেড়াতে বেড়াতেই ১০ বছর বয়সে বিক্রি হয়ে যায় নিজের অগোচরে।এরপর ঠিকানা হয় এক ‘মাসী’র কাছে। পতিতাবৃত্তির জীবন। কান্দুপট্টি থেকে টানবাজার। জীবনের সমীকরণে মাঝে অনেক বছর চলে যাওয়া। এরপর ভাসমান পতিতা হিসেবেই কাটান।
বিয়ে হলেও বেশিদিন আর সংসার করা হয় না হাজেরার। ফিরে আসেন পুরানো পেশায়। পোশাক তৈরির কারখানায়ও কাজ করেন কিছুদিন। বেসরকারি সংস্থা ‘কেয়ার বাংলাদেশে’ কাজ নিলেন। সংগঠনের মাধ্যমে লেখাপড়া ও হাতের কাজ শেখেন।এসময় এইচআইভি এইডস এর প্রকল্পে সচেতনতা তৈরি করতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়েছেন, প্রায় ১২টি দেশে ভ্রমণ করেছেন।
পরে ‘দূর্জয় বাংলা’য় ‘চাইল্ড কেয়ার সেন্টারে।’ ভাসমান যৌনকর্মীদের সন্তানদের দেখভালের কাজ পেয়ে যান তিনি।’ একসময় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলেও এসব শিশুদের মায়া ভুলতে পারেন না তিনি। জীবনের শেষসম্বল দিয়ে দুজন সহায়তাকারী,একজন শিক্ষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু স্বেচ্ছাসেবক এর স্বেচ্ছাশ্রমে ২০১০ সালে নিজ উদ্যোগে সাভারের উত্তর রাজাসনে ২০ জন শিশু নিয়ে ‘শিশুদের জন্য আমরা’ এই নামে একটি সংগঠন করেন তিনি। পরে ২০১১ সালের মাঝামাঝি থেকে রাজধানীর মোহাম্মদ পুর এলাকায় সুনিবিড় হাউজিং সোসাইটিতে তার কার্যক্রম চলে।
হাজেরা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে রাস্তায় ছিলাম। দেখতাম যৌনকর্মীদের বাচ্চা চুরি হয়, অনেকে তাদের মায়ের আদিম পেশায় ফিরে যায়। রাস্তায় বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়,স্বপ্ন দেখতাম এসব শিশুদের জন্য কিছু করার জন্য। বিদেশে যখন গিয়েছি সেসময় যতটুকু পেরেছি তা জমিয়ে রেখেছি। পরে এসব টাকা দিয়ে দুইবছর কারো সাহায্য ছাড়াই সংগঠনের কার্যক্রম চালিয়ে গেছি। সমাজ সচেতন কিছু মানুষ এই শিশুনিবাসটিকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন,সবসময় যৌনকর্মীদের সমাজে হেয় করে দেখা হয়,তাদের সন্তানদেরও পিতৃ পরিচয় থাকে না। আমি আমার বাবার নাম দিয়ে এসব শিশুদের ভর্তি করাই। কারো কারো নাম দেই আমাদের ভলান্টিয়ারদের নামে। এসব শিশুরা আমার পরিচয়ে মানুষ হচ্ছে। আগে এসব শিশুদের ভর্তি করাতে অনেক সমস্যা হতো। এখন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হয়েছে। যদি সরকারি সহযোগিতা পাওয়া যায় তাহলে এসব শিশুদের আরো এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।’
হাজেরা বলেন,এসব শিশুরা প্রাইমারি ও হাইস্কুলে পড়ালেখা করছে। প্রতি সপ্তাহে দুদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবক দলটি এসে পড়িয়ে যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজয়ানা চৌধুরী বন্যার গানের স্কুল সুরের ধারায় ৮ জন শিশু গান শিখতে যায়। এছাড়া অবসরে এদের সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্ত করা হয়। এদের তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্ম নিয়ে শিগিরই প্রদশর্নী করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এই সংগঠনের সেচ্ছাসেবক সামিউল হাসান রঞ্জু বলেন, হাজেরা বেগমের স্বপ্ন পূরণে অনেকে যেমন এগিয়ে এসেছেন তেমনি অনেক মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে তাকে হেয় করেছে। কাজে বাঁধা দিয়েছে। কিন্তু আমরা এই সংগঠনের শুরু থেকেই তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি।
সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশু স্বপন। আখাউড়া থেকে এই শিশুটিকে আহত অবস্থায় দূর্জয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন একজন। কয়েকদফা চিকিৎসার পর সুস্থ এই শিশুটিকে নিয়ে তিনি বলেন,ওর বাবা মার পরিচয় পাওয়া যায়নি। কিন্তু তার জন্য আমার ¯েœহ ও ভালোবাসা আরো বাচ্চাগুলোর মতই- বুকে জড়িয়ে আদর করতে করতে বলছিলেন হাজেরা।
এই শিশুনিবাসের বাসিন্দা রমজান,আকাশ, সাইদ রবিন,রাহাত এরা নবম ও দশম শ্রেণীতে পড়ছে। অন্যরা সকলে প্রাইমারিতে পড়ছে স্থানীয় বিভিন্ন বিদ্যালয়ে।
দশম শ্রেণীর ছাত্র সাইদ জানায় লেখাপড়া শিখে দেশের জনসাধারণের সেবা করতে মন্ত্রী হতে চায়। অস্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।আর নবম শ্রেণীর আকাশ বড় হয়ে পাইলট হবার স্বপ্ন দেখে।
সমাজকল্যাণ পরিষদের গবেষণা ও প্রকাশনা কর্মকর্তা ওয়াহিদা আক্তার বলেন, দেশে প্রথমবারের মতো আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অবসর নেয়া যৌনকর্মীদের বর্তমান অবস্থার ওপর সমীক্ষা সংক্রান্ত ফলাফলে (খসড়া) অবসর নেয়া যৌনকর্মীরা যাতে সরকারি সহযোগিতায় আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ পায় সে বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।