বঙ্গমাতা ছিলেন অসাধারণ নীরব সহযোগী : মালেকা খান

300

॥ মাহফুজা জেসমিন ॥
ঢাকা, ৭ আগস্ট, ২০২০ (বাসস) : বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কোন রাজনীতিবিদ নন কিংবা কুটনীতিকও নন। কোনো বিশেষ পরিচয়ের জন্যও তিনি উন্মুখ ছিলেন না। এসব পোশাকি পরিচয়ের উর্ধ্বে থেকেই নীরবে নিভৃতে জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা কওে গেছেন। তাঁর দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং বিচক্ষণতার জন্যই তিনি অনন্য, তিনি বঙ্গমাতা।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনব্যাপী তাঁর প্রবল উপস্থিতিই যেন বঙ্গবন্ধুকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। বঙ্গমাতাকে যারা কাছে থেকে দেখেছেন, তাঁর পাশে বসেছেন, তাঁর ¯েœহের পরশ পেয়েছেন তাদের সবার কাছে তিনি ‘অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন’ এক নারী। এক দায়িত্বশীল মা। বঙ্গবন্ধুর উপযুক্ত সহযোদ্ধা, এক নীরব সহযোগী।
আগামীকাল ৮ আগস্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৯১তম জন্মদিন। এই দিনটিকে সামনে রেখেই কথা হয়, সমাজকর্মী মালেকা খানের সঙ্গে। যিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে যখন তখন যেতে পারতেন। তাঁদের পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন।
মালেকা খানের স্মৃতিতে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ‘অসাধারণ দৃঢ় এক ব্যক্তিত্ব’। তিনি বলেন, ‘বেগম মুজিব চালচলন এবং কথাবার্তায় খুব সাধারণ ছিলেন। কিন্তু তাঁর সহযোগিতা, অসাধারণ সহযোগিতা। নীরব সহযোগিতা। যার জন্য শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠেছেন। কাছে না গেলে আমরা হয়তো তাঁকে জানতে পারতাম না। বুঝতে পারতাম না।’
বঙ্গবন্ধুর পাশে বেগম ফজিলাতুন্নেছা যেভাবে ছিলেন, সেভাবে যদি না থাকতেন, বঙ্গবন্ধু এতো স্বাধীনভাবে নিজের মতো করে চলতে পারতেন না। রাজনীতি করতে পারতেন না। তাঁকে সংসার দেখতে হয়নি। সংসার নিয়ে চিন্তা ও করতে হয়নি। সবটাই বেগম ফজিলাতুন্নেছা দেখাশোনা করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কাজে বা তাঁর রাজনীতিতে কখনো অন্তরায় হয়ে ওঠেন নি।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যারা দেখা করতে আসতেন কাউকেই খালি মুখে বিদায় করতেন না বেগম মুজিব। মালেকা খান বলেন, ‘যখনই গেছি দেখেছি, ডালাভর্তি খাবার এগিয়ে দিয়ে বলছেন, এই এগুলো নিয়ে ওদের খেতে দে। কখনো বিরক্ত হতে আমি দেখিনি। সবটাই স্বচ্ছন্দে করেছেন।’
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই যুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে কবি বেগম সুফিয়া কামাল এবং লালমাটিয়া মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ্য বদরুন্নেসা আহমদের উদ্যোগে ‘কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থা’ গঠিত হয়। ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি থেকেই এটি পুরোদমে কাজ শুরু করে। মালেকা খান শুরুর দিন থেকেই এ সংস্থায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি সংস্থার পরিচালক নিযুক্ত হন। সংস্থার কাজের সুবাদেই বদরুন্নেসা আহমদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। তার সঙ্গেই বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে যোগাযোগ।
বেগম মুজিব নিয়মিত কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থার মেয়েদের খোঁজ খবর নিতেন। তাঁর বাসায় গেলে বদরুন্নেসা আহমদের কাছে মেয়েদের কি কি সমস্যা হচ্ছে এগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইতেন। তাদের সমস্যা মন দিয়ে শুনতেন। প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুকে বলে সাহায্যের ব্যবস্থা করতেন।
মালেকা খান জানান, বেগম মুজিব নির্যাতিত নারীদের প্রকৃত অবস্থা নিজ চোখে দেখার জন্য ২০ নিউ ইস্কাটন রোডের পুনর্বাসন কেন্দ্রে সশরীরে উপস্থিত হতেন। তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। খোঁজ খবর নিতেন।
সাবেক গার্লস গাইড এসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মালেকা খানের কাছেই জানা যায়, পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধে বাবা-মা আত্মীয় পরিজন হারানো একটি মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে বেগম সুফিয়া কামাল জাতির পক্ষ থেকে স্বামীর হাতে তুলে দেন মেয়েটাকে। এই বিয়েতে বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিব এসেছিলেন। তিনি সেদিন ওই মেয়েকে দেড় ভরি ওজনের একটি সোনার চেন উপহার দেন।
মালেকা খানের স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়ে বঙ্গমাতার অসাধারণ বাঙালী নারী চরিত্রের এক পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর মতো অমন বিশাল ব্যক্তিত্বের মানুষের জীবন জুড়ে থেকেও তিনি তার নিজের চিরায়ত অবস্থান থেকে বিচ্যুৎ হন নি।
একবার কয়েকজন পেশাজীবী মহিলা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিন্তু কেমন করে যাবেন। তখন মালেকা খান নিয়মিতই ওই বাসায় যাতায়াত করেন। মালেকা খান তাদের বললেন, ‘আপনারা যদি যেতে চান, চলেন নিয়ে যাই।’ তাদের মধ্যে কলেজের অধ্যাপিকা এবং চিকিৎসকও ছিলেন। তারা তো অবাক, কোন এপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কেমন করে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করা যাবে? মালেকা খান কিন্তু তখনই দুটো গাড়িতে করে সবাইকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হাজির হলেন। সেন্ট্রি পরিচিত হওয়ায় এতোজনকে নিয়ে ঢুকতেও কোনো সমস্যা হলো না।
মালেকা খান বলেন, ‘৩২ নম্বরের বাড়িতে তাদের বাইরের ঘরে বসিয়ে রেখে বেগম মুজিবকে যেয়ে বললাম, কয়েকজন পেশাজীবী মহিলা আপনার সাথে দেখা করতে চান। তিনি বললেন, ঠিক আছে ওদের বসতে বলো। আমি চা’টা বানিয়ে দিয়ে একবারেই আসি। আমি ওদের বসিয়ে আবার গেলাম। তারপর তিনি চা বানালেন। আমার হাতে ট্রেতে কয়েকটা কাপে চা দিয়ে বললেন, এগুলো ওদের দাও, আমি আসছি। চায়ের সাথে নাস্তাও দিলেন। উনি যেভাবে ছিলেন, সেভাবেই গায়ের কাপড়টা একটু ঠিকঠাক করে ওদের সাথে দেখা করতে আসলেন। একটু বসলেন। সবার সাথে পরিচিত হলেন। কুশল বিনিময় করলেন। তারপর ভদ্রমহিলারা চা খেয়ে চলে আসলেন।’
বঙ্গমাতার এই অনন্যসাধারণ রূপ দেখে সেদিনের সেই ভদ্রমহিলারা হয়তো নিরাশই হয়েছিলেন। তারা ওনাকে দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এতো বড় মানুষের স্ত্রী, এতো সাধারণভাবে থাকেন? এটা যেন অবিশ^াস্য! বিস্ময়কর!’ মালেকা খান সেদিনও চুপচাপ সব দেখেছিলেন। আর বঙ্গমাতার অনন্য সাধারণ জীবন-যাপনাটা চোখের মধ্যে, মনের মধ্যে গেঁথে নিয়েছিলেন।
বেগম মুজিবের সহজ সরল ব্যক্তিত্বই যেন তাঁকে নিয়ে বেশি কিছু ভাবার অবকাশ দেয়নি। মালেকা খান বলেন, ‘সবাই ওনাকে ভাবী ভাবী বলতো। আমিও মাতৃতুল্য ভদ্র মহিলাকে বোকার মতো ভাবীই বলেছি। অত বড় একজন মানুষ, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিবকে কখনো খালাম্মা বা অন্য কিছু ডাকার চিন্তাই আসেনি।’
‘তিনি একজন মা হিসেবেও ছিলেন, আরো দশজন মায়ের মতোই। সন্তানদের জন্যও আলাদা কিছু তাকে করতে দেখিনি। যেমন, খাবার দিয়ে বলতেন, সবাইকে নিয়ে খাও। সবাইকে নিয়ে মানে, রাসেল খাবে, রেহানা খাবে। আমরাও খাবো।’
লালমাটিয়া মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ বেগম বদরুন্নেসা আহমদ ১৯৭৩ সালে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। ১৯৭৪ সালের ২৫ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সেদিনই বেগম মুজিবের সাথে মালেকা খানের শেষবারের মতো কথা হয়।
‘বদরুন আপার মৃত্যুর দিন বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতা দু’জনই বদরুন আপার বাসায় এসেছিলেন। বেগম মুজিব আমার পাশেই বসেছিলেন। তিনি কুশল জানতে চাইলেন। তারপর উঠে গিয়ে বদরুন আপার কফিনের চারপাশে ঘুরে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দোয়া পড়লেন। আমি সেদিন বসে বসে এ দৃশ্য দেখেছিলাম। সেদিনই ওনাদের সাথে আমার শেষ কথা হয়।’
শেখ মুজিব পরিবারের সঙ্গে মালেকা খানের শেষ দেখা হয় ১৯৭৫ সনের মে মাসের ১৮ তারিখে। সেদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিজস্ব ভবন পরিদর্শনে যান। মালেকা খানের নিজের হাতে তৈরি ইকেবানা ফুল দিয়ে বিটিভি’র নতুন ভবনের গেট সাজানো হয়েছিলো। এটা দেখে বঙ্গবন্ধু খুব প্রশংসা করেছিলেন। মালেকা খান সেদিন সালাম দিয়ে দূরে দাঁড়িয়েই তাঁদের দেখেন।
এই অনন্য স্মৃতির ভান্ডার যে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে শোকের পাথর হয়ে উঠবে কেউ কি ভেবেছিলো! মালেকা খানের লালমাটিয়ার বাসা থেকে সারারাত গুলির আওয়াজ। আতংকিত রাতের শেষে ১৫ আগস্টের সকালে প্রথম রেডিও খুলেই মেজর ডালিমের ঘোষণা ‘হতবাক’ করে দিয়েছিলো পুরো পরিবারকে। তিনদিন পর্যন্ত বাসার কেউ খাবার পর্যন্ত খেতে পারেন নি! করোনাকালের বাস্তবতায় টেলিফোন সাক্ষাতকারেও শেষ কথাগুলোয় বেদনার রেশ থেকে যায় অনেকক্ষণ।