করোনা সংকটে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শিক্ষার্থীদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে

650

॥ তানজিম আনোয়ার ॥
ঢাকা, ৩০ জুন, ২০২০ (বাসস) : কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এসময় শিক্ষার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ উদ্যোগ দেশের ৪ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল ডিভাইসগুলোই এখন তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর একমাত্র উপায়।
মারাত্মক করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য সরকার গত ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। সংক্রমণের মাত্রা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী ৬ আগষ্ট পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার কিছুদিনের মধ্যেই প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর রাষ্ট্র পরিচালিত ‘সংসদ টিভি’ চ্যানেলের মাধ্যমে এবং ইউটিউব ও ফেসবুকের মতো অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যাবহার করে ডিজিটাল পাঠদান পরিচালনা করে আসছে।
শিক্ষার্থীরা যাতে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকতে পারে সেজন্য সরকার সব কলেজ এবং বিশ^বিদ্যালয়কে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়।
আইটি উদ্যোক্তা আরশি কাজী বাসস’কে বলেন, ‘যেহেতু আমরা অভিভাবকরা বর্তমানে বাসা থেকেই পেশাগত কাজ করছি তাই, আমরা শিক্ষকদের সাথে আরো বেশি যোগাযোগ রাখতে পারছি। আমি এটিকে (অনলাইন ক্লাস) বেশ ভাল ও সহায়ক বলে মনে করি।’
তিনি জানান, তার সাত বছর বয়সী মেয়ে ফাতিহা ধানমন্ডির একটি কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থী। সে ট্যাব ব্যবহার করে আনন্দের সাথেই প্রতিদিন ভার্চুয়াল ক্লাসে অংশ নিচ্ছে এবং ক্লাস শেষে নিয়মিত বাড়ির কাজ করছে।
আরশি কাজী মনে করেন, যেসব শিক্ষকরা প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে আছেন তারা কিছু সমস্যায় পড়ছেন। কিন্তু তারাও অন্যের সাহায্য নিয়ে কাজ করতে পারছেন।
তিনি বলেন, আশাকরি সবকিছু ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও এই ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত নিজের সন্তানকে স্কুলে পাঠাবেন না বলেও তিনি জানান।
সারাদেশে সব শিক্ষার্থীর জন্য শতভাগ ইন্টারনেট সংযোগ না থাকলেও বেশিরভাগ বাড়িতেই টেলিভিশন আছে। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় টেলিভিশনের মাধ্যমে পাঠদানের প্রতি বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।
রাজধানীর উত্তরার অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী ইফফাত মুনতাহা ইউশা বলেন, ‘টিভি বা অনলাইনে ক্লাস করা কোন কঠিন ব্যাপার না। তবে, অনলাইন বা টিভির ক্লাসের বিষয়বস্তু মাঝেমাঝে খুবই একঘেয়ে লাগে।’
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ বাসস’কে বলেন, ‘বর্তমানে আমরা প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে রবি থেকে বৃহস্পতিবার প্রতিদিন বিশ মিনিটের তিনটি ক্লাস সারা দেশে সম্প্রচার করছি।’
তিনি জানান, সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচি’র ফ্ল্যাগশিপ কার্যক্রম এটুআই (একসেস টু ইনফরমেশন) এর সহায়তায় তার অধিদপ্তর ‘ঘরে বসে শিখি’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেল তৈরী করেছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল ক্লাসগুলি আপলোড করা হচ্ছে।
মহাপরিচালক বলেন ‘আমরা অভিভাবকদের কোন বিষয়ের ক্লাস কখন প্রচারিত হবে তা জানিয়ে এসএমএস করছি। আমাদের কাছে দুই কোটি প্রাথমিক শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের ফোন নম্বরের একটি ডাটাবেস আছে। এর মধ্যে সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৪০ লাখ।’
এছাড়াও, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসনও নিজ নিজ এলাকায় ছাত্র ছাত্রীদের অনলাইন ক্লাসের সুবিধা দিচ্ছে।
সারাদেশের সব শিক্ষার্থীর কাছে এই ‘দুর শিক্ষণ’ সুবিধা পৌছে দেওয়াটা এখনও সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ। সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে যাদের টেলিভিশন সুবিধা নেই।
মো. ফসিউল্লাহ বলেন, আগামী মাস থেকে যতটা সম্ভব প্রান্তিক (হার্ড টু রিচ) শিক্ষার্থীদের জন্য রেডিওতে ক্লাস সম্প্রচার করা হবে।
তিনি আরো বলেন, যাদের ইন্টারনেট ও টেলিভিশন সুবিধা নেই তারা খুব তাড়াতাড়ি রেডিওতে ক্লাসের লেকচার শুনতে পারবে। বাড়ি থেকে শেখার অগ্রগতি জানার জন্য যাদের টেলিভিশন ও ইন্টারনেট সুবিধা নেই সেসব শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সাথে শিক্ষকদের ফোনে যোগাযোগ রাখতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মতো মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরও শিক্ষার্থীদের জন্য সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে ক্লাস প্রচার করছে। এছাড়াও ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য ‘কিশোর বাতায়ন’ ও ‘আমার ঘর আমার স্কুল’ নামের দুটি ইউটিউব চ্যানেলে পূর্বে ধারণ করা ক্লাস প্রচারিত হচ্ছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. গোলাম ফারুক জানিয়েছেন, সংসদ টিভির মাধ্যমে প্রচারিত ক্লাসগুলি ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছে এবং আগামী দিনগুলোতে এই কর্মকান্ড আরো বাড়ানো হবে।
অন্যদিকে, ইউনিসেফ সরকারের সাথে যৌথভাবে টেলিভিশন, রেডিও, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষা সুবিধা পৌঁছানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে তারা শিক্ষকদের জন্য কার্যকর দূর শিক্ষণ গাইডলাইন তৈরী করছে।
ইউনিসেফ বাংলাদেশ-এর শিক্ষা বিভাগের প্রধান নূর শিরিন মো. মোখতার বাসস’কে বলেন ‘আমাদের ভাবনার মূল কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে সমতা ভিত্তিক শিক্ষা। কম সুবিধাভোগী শিশুরা যেন বাদ না পড়ে যায়, সেজন্য আমাদের জরুরী ভিত্তিতে শিক্ষার বিকল্প উপায়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে।’
বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কার্যালয় সুত্রে জানা যায়, তারাও তাদের অধিভুক্ত ১৫১ টি পাবলিক ও বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়কে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)’র উপাচার্য মেজর জেনারেল আতাউল হাকিম সারোয়ার হাসান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অনলাইন ক্লাস চালু করার উদ্যোগকে আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইউজিসি’র নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছি।
তিনি বলেন, লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো নিয়মিত ক্লাসে যেখানে ৮২-৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকত, সেখানে ভার্চুয়াল ক্লাসে ৯০-৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে।
সারোয়ার হাসান আরো বলেন, ‘আমরা এরইমধ্যে প্রথম সেমিস্টার শেষ করেছি এবং এখন আমরা অনলাইনে ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষা করছি।’
এদিকে, আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন যে, সরকার দেশে আইসিটি-ভিত্তিক শিক্ষার প্রসারের জন্য স্কুল পর্যায়ে আরও ৫,৫০০ টি শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করবে।