তেলিয়াপাড়া দিবস আগামীকাল ৪ এপ্রিল

647

হবিগঞ্জ, ৩ এপ্রিল, ২০১৮ (বাসস) : তেলিয়াপাড়া দিবস আগামীকাল ৪ এপ্রিল। ১৯৭১ সালের এ দিনে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোয় যুদ্ধের রণকৌশল গ্রহণ করার প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উর্ধ্বতন ২৭ সেনা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে এ বৈঠকেই দেশকে স্বাধীন করার শপথ এবং যুদ্ধের রণকৌশল গ্রহণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণকে ভাগ করা হয় ১১টি সেক্টর ও ৩টি ব্রিগেডে। অস্ত্রের যোগান, আন্তর্জাতিক সমর্থনসহ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এ সভায়।
প্রতি বছর ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এর উদ্যোগে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ বছরও এ দিনটিকে জাতীয়ভাবে তেলিয়াপাড়া দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
হবিগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার এডভোকেট মোহাম্মদ আলী পাঠান বলেন, এবার অনুষ্ঠানে আলোচনা সভায় ৩নং সেক্টর কমান্ডার তেলিয়াপাড়া স্মৃতি সৌধের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সেনা প্রধান মেজর জেনারেল (অবঃ) কেএম শফিউল¬াহ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অবঃ) হেলাল মোরশেদ খান, মুক্তিযুদ্ধ সংসদ বিষয়ক চেয়ারম্যান ক্যান্টেন তাজ, সংসদ সদস্য এডভোকেট আবু জাহির, সংসদ সদস্য এডভোকেট আব্দুল মজিদ খান, সংসদ সদস্য এডভোকেট মাহবুব আলী, জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ, সাবেক জিআইজি মকবুল হোসেন, পুলিশ সুপার ত্রিপুরাসহ পার্শ্ববর্তী জেলা বি-বাড়ীয়া, মাধবপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার, ডেপুটি কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জোটের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন।
১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কর্নেল (অবঃ) আতাউল গণি ওসমানী, তৎকালীন মেজর সিআর দত্ত, মেজর জিয়াউর রহামন, কর্ণেল এমএ রব, রব্বানী, ক্যাপ্টেন নাসিম, আব্দুল মতিন, মেজর খালেদ মোশাররফ, কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী, ভারতের ব্রিগেডিয়ার শুভ্রমানিয়ম, এমপিএ মৌলানা আসাদ আলী, লেঃ সৈয়দ ইব্রাহীম, মেজর কেএম শফিউল্লাহ প্রমূখ।
কর্নেল (অবঃ) এম জি ওসমানীর নেতৃত্বে নেয়া হয় যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি। শপথ বাক্য পাঠ করানোর পর নিজের পিস্তল থেকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন এম এ জি ওসমানী।
১ নং সেক্টরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান পরে মেজর রফিকুল ইসলাম। দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন প্রথমে খালেদ মোশাররফ পরে মেজর হায়দার। তিনি নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন প্রথমে মেজর শফিউল্লাহ পরে মেজর নূরুজ্জামান। চার নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর সি আর দত্ত। পাঁচ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী। ছয় নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন উইং কমান্ডার বাশার। সাত নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর কাজী নূরুজ্জামান। আট নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন প্রথমে মেজর ওসমান চৌধুরী মেজর এমএ মনছুর। নয় নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন প্রথমে মেজর আব্দুল জলিল এবং অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন এমএ মঞ্জুর। দশ নম্বর সেক্টর নৌ-বাহিনীর সৈনিকদের নিয়ে গঠন করা হয়। এগার নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজন আবু তাহের ও পরে ফ্লাইট লেঃ এম হামিদুল্লাহ। আর জিয়াউর রহমানের নামের অনুসারে ‘জেড ফোর্স’ জিয়াউর রহমানের দায়িত্বে, মেজর শফিউল্লাাহর নাম অনুসারে ‘এস ফোর্স’ মেজর সফিউল্লাহর দায়িত্বে এবং খালেদ মোশাররফের নাম অনুসারে অপর ব্রিগেড ‘কে ফোর্সে’র দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর খালেদ মোশাররফের উপর।
ওই সভায় ১০ এপ্রিল দ্বিতীয় বৈঠক ও সরকার গঠনের প্রস্তাবও করা হয়েছিল। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি।
তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও তখনকার সময় হবিগঞ্জের এসডিও আকবর আলী জানান, আমি জানতাম ৪ এপ্রিলের মিটিং এর বিষয়ে। কিন্তু আমি মিটিংএ যাইনি।
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির সভাপতি মেজর জেনারেল (অবঃ) সৈয়দ ইব্রাহিম, জানান, স্বাধীনতা ঘোষনার পর ৪ এপ্রিল প্রথম কোন আনুষ্ঠানিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। আমিও সেই মিটিংএ ছিলাম। মিটিংএ কর্নেল (অবঃ) ওসমানীকে সেনা প্রধান করা হয় । তিনি তখন বিভিন্ন অফিসারকে বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্ব দেন। পরবর্তিতে সেগুলো সেক্টর হিসেবে অনুমোদন পায়। ওসমানী আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য এবং রাজনীতিবিদদেরকে নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য।
৩নং সেক্টর কমান্ডার মেজর কে.এম শফিউল্লাহ্ তাঁর হেড কোয়ার্টার স্থাপন করেন তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। সড়ক ও রেলপথে বৃহত্তর সিলেটে প্রবেশের ক্ষেত্রে মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়ার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এখান থেকে মুক্তি বাহিনী বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করা ছাড়াও তেলিয়াপাড়া চা বাগানে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে উঠে। কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানীসহ কয়েকটি সেক্টরের কমান্ডারগণ বিভিন্ন সময়ে তেলিয়াপাড়া সফর করেন। ম্যানেজার বাংলোসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সেনানায়কদের পদচারণায় মূখরিত। ১৯৭১ সালের ২১ জুনের পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণের কারণে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে স্থাপিত সেক্টর হেড কোয়ার্টার তুলে নেয়া হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২, ৩ ও ৪নং সেক্টরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে তেলিয়াপাড়া চা বাগান ম্যানেজার বাংলোর পাশে নির্মিত হয় বুলেট আকৃতির মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মৃতিসৌধ। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে এ স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ বীর উত্তম পিএসসি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলেও সেটি সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ ছিল না দীর্ঘদিন যাবৎ। ২০১১ সালের ৭ মে মুক্তিযুদ্ধাদের এক সমাবেশে সেখানে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স করার কথা ঘোষণা করা হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন, সাবেক মন্ত্রী মরহুম এনামুল হক মোস্তফা শহীদ, সাবেক চীপ হুইফ ও তখনকার বাংলাদেশ টি বোর্ডের চেয়ারম্যান উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ। সভায় উপস্থিত এলজিইডির তখনকার প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমানকে দায়িত্ব দেয়া হয় প্রকল্প গ্রহণ করার জন্য। পরবর্তিতে এলজিইডি ৩ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তুসেই প্রকল্পের কোন কাজই হয়নি। উপরন্তো ন্যাশনাল টি কোম্পানী স্মৃতি সৌধকে পৃথক করে ঐতিহাসিক বাংলোটিকে বাউন্ডারী দিয়ে আলাদা করে ফেলে। এক সময় সেখানে তারকাটার বেড়া থাকলেও ছিল একটি পকেট গেইট। কিন্তু বর্তমানে বাউন্ডারী থাকায় কেউ দেখতে পারেন না বাংলোটিকে। এ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধা এবং সাধারন মানুষের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
হবিগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধা সংসদ ইউনিট কমান্ডার অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী পাঠান বলেন, বর্তমান সরকার দেশের সকল মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত স্থানকে সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু তেলিয়াপাড়ায় কোন কাজই হয়নি। ১০০ একর জমিতে সেখানে কমপ্লেক্স করে বিভিন্ন ভাস্কর্য করার কথা ছিল।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য ক্যাপ্টেন (অব.) কবির হোসেন বলেন, তেলিয়াপড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান স্মৃতি বিজড়িত স্থান। অবশ্যই এটিকে সংরক্ষণ করতে হবে। তিনি অবিলম্ভে সেখানে রেস্ট হাউজ, টয়লেট নির্মাণসহ উন্নয়ন মূলক কার্যক্রম গ্রহণের দাবি জানান। পাশাপাশি ঐতিহাসিক বাংলোটিকে যাদুঘর করার দাবি জানান।