এইডস আক্রান্তে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে আছে শিরায় মাদক গ্রহণকারীরা

1449

ঢাকা, ৪ জুন, ২০২০ (বাসস) : ছোটবেলাতেই এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-মাকে হারান নাফিসা আক্তার রানু (ছদ্ম নাম)। দেখার মত কেউ না থাকায় ঠাঁই হয় মামা-মামীর সংসারে। মাস না ঘুরতেই শুরু হয় নির্যাতন। নানী যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন কিছুটা আদর পেতেন। নানী মারা যাওয়ার পর নির্যাতন আরো বেড়ে যায়। মাত্র দশ বছর বয়সেই ঘরের সব কাজই করতে হত রানুকে। কাজ করেও শান্তি নেই। মামী উঠতে-বসতেই মারতেন। খাবার দিতেন দু’বেলা।
মামা-মামীর সংসারে এ ভাবেই আরো ছয় বছর থাকার পর একদিন রাতে ছোট্ট এক অপরাধে বেদম মারধরের শিকার হন রানু। সেদিন রাতেই সিদ্ধান্ত নেন এভাবে আর নয়। পর দিন ভোরবেলা কাউকে কিছু না বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ে রানু। দু’রাত রাস্তাতেই কেটে যায় তার। পরদিন পরিচয় হয় এক মহিলার সাথে। রানু তাকে খালা বলে সম্বোধন করে। খালা সব কথা শুনে নিয়ে যান সাথে করে। সেখানে তিন দিন রাখার পর খালা রানুকে বেঁচে দেন এক দালালের হাতে। ওই দালাল তাকে বাধ্য করায় যৌন কর্মী হিসেবে কাজ করতে। এভাবে সেখানে প্রায় চৌদ্দ বছর কাটানোর পর পালিয়ে আসে রানু।
বর্তমানে রানু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত রাজধানীর একটি এইচআইভি ও এইডস সেবা কেন্দ্রে কাজ করছেন। সেখানে তিনি অন্য নারী যৌনকর্মীদের এইচআইভি ও এইডস বিষয়ে সচেতন করেন।
রানু বলেন, যখন এ পেশায় আসি তখন প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হয়েছি। খদ্দেরের সাথে যেতে না চাইলে খুব মারত। তখন এতো কিছু জানতাম বা বুঝতাম না। তখন কনডমের ব্যবহারও তেমন ছিল না। ফলে শুরুতেই অনেক ধরনের যৌন রোগে ভুগেছি। তবে ভাগ্য সহায় যে এইডস হয়নি। তবে এখন যৌন কর্মীরা আগের চেয়ে অনেক বেশী সচেতন। তারা কনডম ছাড়া কাজ করতে চায় না। আবার বেশিরভাগ খদ্দেরও কনডম ব্যবহার করে।
নগরীর বাসাবোতে একটি বেসরকারী মাদক নিরাময় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা মেলে কয়েকজন শিরায় মাদক সেবনকারী রোগীর সাথে। তাদের সবার গল্পই প্রায় এক। তারা এক সিরিঞ্জ দিয়ে কয়েকজন মিলে শিরায় মাদক নিত। কিন্তু তারা জানেনা এটা তাদের জন্য কতটা ঝুঁকিপুর্ন।
প্রতি বছর ১ ডিসেম্বর পালিত হয় বিশ্ব বিশ্ব এইডস দিবস। বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে দিবসটি পালিত হয়।
বর্তমানে এইডসের ক্ষেত্রে সব থেকে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে শিরায় মাদকগ্রহণকারীরা।
সরকারী হিসেব মতে, দেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। এ পর্যন্ত ৬,৪৫৫ জন এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন। আর এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১,০২২ জন। দেশে এইচআইভি সংক্রমিত মানুষের অনুমিত সংখ্যা ১৩ হাজার। তাদের সবাইকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
ভৌগোলিক অবস্থান ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভির প্রাদুর্ভাব বিবেচনায় নিয়ে ২০১৫-২০১৬ সালের সরকারের জরিপ অনুযায়ী দেশে যৌনকর্মীর সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ২৬০ জন।
সেভ দ্য চিলড্রেন সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে যৌনকর্মীর জন্য ১২টি জেলায় এবং মাদক গ্রহণকারীদের ৬টি জেলায় সেবা দিচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ঘনত্ব অনুযায়ী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন জেলায় যৌনকর্মীদের জন্য ২৯টি এবং মাদক গ্রহণকারীদের জন্য ২১টি ড্রপ-ইন সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে। এই কাজে আরো কয়েকটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা সহায়তা করছে।
সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. পারভীন বলে, নারী যৌনকর্মীদের মধ্যে কনডম ব্যবহারের হার আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। খদ্দেররাও এখন সচেতন। তবে কেউ কেউ কনডম ব্যবহার করতে চাননা। ফলে ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
তার মতে, এ রোগ যেন না ছড়ায় সেজন্য সরকারের আরো বেশী সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।