করোনা পরিস্থিতিতে নিভৃতে কেটে গেলো বরগুনা গণহত্যা দিবস

298

বরগুনা, ৩০ মে, ২০২০ (বাসস) : বরগুনাবাসীর জন্য রক্তাক্ত স্মৃতি বিজড়িত দু’টো দিন ২৯ ও ৩০ মে। একাত্তরে এ দু’টি দিনে বরগুনা জেলখানায় আটক নিরীহ বাঙ্গালীদের গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পাক হানাদার বাহিনীর রোষানলের শিকার হয়ে অনেক বাঙ্গালী মুসলমান সেদিন কবরের সাড়ে তিন হাত জায়গা পায়নি, হিন্দুরা পায়নি আগুনের ছোঁয়া। তাদেরকে দেয়া হয়েছে একই গর্তে মাটি চাপা।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ একাত্তর বরগুনার সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন মনোয়ার জানান, প্রতিবছর শোক র‌্যালি, শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভা, দোয়ানুষ্ঠান ও শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বরগুনা গণহত্যা দিবস পালিত হলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে এ বছর অনানুষ্ঠানিকভাবে নীরবে-নিভৃতেই কেটে গেলো দিন দু’টি। প্রতিবছরই বরগুনা সাগরপাড়ি খেলাঘর, প্রেস ক্লাব, লোকবেতার, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ’৭১ ও এনসিটিএফ যৌথভাবে দিবসটি পালন করে। জানালেন, লোকবেতারের স্টেশন ম্যানেজার মনির হোসেন কামাল।
বরগুনা শহরের পৌর এলাকার শহীদ স্মৃতি সড়ক দিয়ে দক্ষিণ দিকে হেটে গেলে চোখে পড়বে লাল রং করা পাচিল ঘেরা জেলখানা। জেলখানার দক্ষিণ পাশে শহীদদের গণকবর। যেখানে বরগুনার মুক্তিকামী মানুষদের মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। ১৯৯২ সনে সেখানে একটা স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। স্মৃতি সৌধের শ্বেত পাথরে লেখা রয়েছে শহীদদের নাম। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যারা শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল, ১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল, তাদেরকে লক্ষ্য করে এই দু’দিনে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ২৬ এপ্রিল তৎকালীন বরগুনা মহাকুমা সদর পাক বাহিনীরা দখলে নেয়। বরগুনার মুক্তিকামী জনতা এসময় ক্ষিপ্ত হয়ে পাক বাহিনীর সাথে লড়াই করার জন্য স্পিড বোট নিয়ে রওনা হয়। কিন্তু পাক বাহিনীর বিমান হামলা ও মারাত্মক অস্ত্রের আঘাতের কথা চিন্তা করে এবং নিজেদের কাছে লড়াই করার মতো অস্ত্র না থাকায় আবার ফিরে আসেন। মুক্তিযোদ্ধারা বরগুনা ছেড়ে লোকালয়ে যাবার সুযোগে মুসলিমলীগ, জামায়াত ও অন্যান্য পাকিস্তানপন্থীরা বরগুনা শহর দখল করে এবং সাবেক মুসলিমলীগ নেতা এম এন এ আবদুল আজিজ মাষ্টার ও পাথরঘাটার তাহের উদ্দিন হাওলাদার পটুয়াখালী গিয়ে পাক বাহিনীদের বরগুনা নিয়ে আসে। তখন বরগুনা শহর ছিল প্রায় জন মানবহীন। এসডিওর জেটিতে পাকবাহিনী পজিশন নিয়ে কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় কিছু লোক জড়ো করে ভাষন দেয়। পরের দিন ১৫ মে পাথরঘাটা থানার বেশ কয়েকজনকে ধরে এনে বিষখালী নদীর তীরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের আহাজারী ও স্বজন হারাদের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠেছিল। বিষখালী নদীর পানি রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। আর এ হত্যাকান্ডে নেতৃত্ব দিয়েছিল, পটুয়াখালী জেলা সামরিক আইন প্রশাসক মেজর নাদের পারভেজ। এসময় পাথরঘাটার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী লক্ষন দাস, তার ছেলে কৃষ্ণ দাস, অরুন দাস ও স্বপন দাসকে ধরে এনে বরগুনা কারাগারে আটক রাখা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে অবস্থানের কারণে সাবেক সিও আতিকুল্লাহ, এস আই আবদুল মজিদ, সিপাহী আড়ি মিয়া ও আবদুল জব্বারকে পটুয়াখালী নিয়ে হত্যা করা হয়।
পাকবাহিনীদের হানায় বরগুনা শহর আস্তে-আস্তে লোকশূন্য হতে থাকে। এসময় পাকবাহিনীরা কুটবুদ্ধির মাধ্যমে মরণ ফাঁদ পাতে। তাদের সহযোগিরা ঘোষণা দেয়, এখানে বসবাসরত হিন্দুদের কিছুই করা হবেনা। পাকবাহিনীরা তখন বরগুনা ছেড়ে পটুয়াখালী চলে যায়। পাকবাহিনীর ঘোষণায় আশ্বস্ত হয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ আওয়ামীলীগ সমর্থকরা বরগুনা শহরে এসে যার-যার বাসায় অবস্থান নেয়। ২৬ মে পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন সাফায়াত চারজন সহযোগী নিয়ে স্পিড বোটে বরগুনা চলে আসে। তাদের আসার খবর সেদিন কেউই পায়নি। পরের দিন সকালে ২/৩ জন করে লোক ধরা শুরু করে। দুপুরে সামান্য বৃষ্টি হলে লোকজন পালাতে থাকে। তখন পাকবাহিনীর সদস্যরা দোনকার ইমাম হোসেনের মত সহযোগিদের নিয়ে নাথপাড়া, পশ্চিম বরগুনা ও শহর এলাকা ঘেরাও করে শতাধিক নারী পুরুষকে বেধে জেলখানায় নিয়ে যায়। পাকবাহিনীর সদস্য ও তাদের সহযোগিরা সিএন্ডবি’র ডাকবাংলোকে ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে। রাতে অনেক অবলা মা-বোনকে জেলখানা থেকে সেখানে নিয়ে গণধর্ষন চালানো হয়। সকাল বেলায় আবার তাদের জেলখানায় পাঠানো হয়। মা-বোনদের রক্তে সেদিন জেলখানার রাস্তার মাটি লাল হয়ে গিয়েছিল। এসব ঘটনার নিরব সাক্ষী মাইঠা গ্রামের ফারুকুল ইসলাম।
২৮ মে পটুয়াখালী জেলা সামরিক আইন প্রশাসক মেজর নাদের পারভেজ বরগুনায় আসে এবং ২৯ মে বরগুনা জেলখানায় প্রহসনমূলক বিচারের ব্যবস্থা করে গণহত্যা শুরু করে। জেলখানার উত্তর-পশ্চিম পাশে বরগুনা জেলা স্কুল অবস্থিত। প্রতিদিনের মতো সেদিনও ছাত্ররা স্কুলে এসেছিল। ক্লাস শুরুর ঘন্টা বাজার সাথে সাথেই প্রচন্ড গুলির শব্দে শহরময় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, সবাই ছুটোছুটি শুরু করে দেয়। বরগুনা জেলখানায় গুলিবিদ্ধ হয়ে তখন একের পর এক মৃত্যুর কোলে ঢলে পরতে লাগলো। প্রথম দিন তারা ৫৫ জনকে হত্যা করেছিল। অনেকে সেদিন গুলি খেয়ে আধা মরা অবস্থায় পরে রয়েছিল। কিন্তু তাদেরও শেষ রক্ষা হয়নি। পরের দিন আবারও ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। জেলখানায় হত্যা করে তাদের সবাইকে একটি গর্তে মাটি চাপা দেয়া হয়। দুইদিনে ৫বার গুলি করার পরও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান সকল ঘটনার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী ফারুকুল ইসলাম। তবে তার অপর দুই ভাই নাসির ও শানুকে মেরে ফেলা হয়। কেষ্ট ডাক্তার নামে পরিচিত কৃষ্ণ দাস গুলিবিদ্ধ হয়েও প্রাণে বেঁচে ছিল। হামাগুড়ি দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাস্তা পাড় হবার সময়ে তাকে ধরে ধরে কোদালের বাট দিয়ে মাথা গুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল পাথরঘাটার লক্ষন দাস ও তার ছেলে অরুন দাসকে। অনেককে পটুয়াখালী নিয়েও হত্যা করা হয়েছে। যাদের অনেকের নাম আজও জানা যায়নি।
বরগুনা সদর ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান পনুকে পটুয়াখালী নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া আয়লা-পাতাকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ মাজেদ ও মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহেরকে খাকদোন নদীর তীরে তৎকালীন এসডিওর ঘাটে গুলি করে হত্যা করা হয়। বরগুনার পুরাতন খেয়াঘাটে কাকচিড়ার মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান কনককে হত্যা করা হয়েছে। বরগুনা কারাগারে ৭২ জন ও অন্য ৬ জনসহ ৭৮ জনের নাম উল্লে¬¬খ করে বরগুনা গণকবরের পাশে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।