নাটোরে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প সমৃদ্ধির জানান দিচ্ছে

273

।। ফারাজী আহম্মদ রফিক বাবন ।।
নাটোর, ৩০ মে, ২০২০ (বাসস) : নাটোর জেলাজুড়ে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প সমৃদ্ধির জানান দিচ্ছে। উপকারভোগীদের আর্থিক বুনিয়াদ সুসংহত হয়েছে। তাদের বাড়িতে যেন ‘দুধে-ভাতে বাঙালী আর মাছে-ভাতে বাঙালী’র পরিবেশ।
ভিশন-২০২১, ভিশন-২০৪১ এবং স্বপ্ন সোপান এই তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ নামে ব্রান্ডিং করা দশটি উদ্যোগের অন্যতম ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য-অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে তহবিল গঠন ও পারিবারিক খামারের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন ও টেকসই উন্নয়ন।
এই প্রকল্পে গঠিত গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতির প্রত্যেক সদস্য মাসে দুইশত টাকা সঞ্চয় জমা দিলে এর বিপরীতে সরকার সমপরিমাণ বোনাস দেন এবং একই সাথে সরকার বাৎসরিক দেড় লাখ টাকার আবর্তক তহবিল প্রদান করে। এভাবে দুইবছরে সমিতির তহবিল প্রায় নয় লাখ টাকায় উন্নীত হয় এবং তহবিলের মালিকানা স্থায়ীভাবে সমিতির সদস্যদের। সদস্যরা সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে আয়বর্ধক কর্মকান্ডে বিনিয়োগ করেন। নিয়মিত উঠান বৈঠক করে সাপ্তাহিক কিস্তিতে নয় বরং সুবিধাজনক সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন সদস্যরা। বেশী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন হলে সমিতি থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত মাত্র পাঁচ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ঋণ নেয়া যায়। ইউনিয়নের ওয়ার্ড বা গ্রাম পর্যায়ে ৪০ জন মহিলা এবং ২০ জন পুরুষকে নিয়ে এই সমিতি গঠন করা হয়।
আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প নাটোর জেলা সমন্বয়কারীর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত জেলায় মোট ৯৬৫টি সমিতি গঠন করা হয়েছে। এসব সমিতির ৩৭ হাজার ৭৮৪ জন সদস্য প্রায় ১১ কোটির অধিক টাকা জমা করেছেন। এই জমার বিপরীতে সরকার সদস্য পর্যায়ে প্রায় প্রায় সাড়ে দশ কোটি এবং সমিতি পর্যায়ে প্রায় ২০ কোটি ২৪ লাখ টাকা অনুদান প্রদান করেছে। সকল সমিতির সদস্যদের চাহিদা অনুযায়ী মোট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে প্রায় অর্ধ শত কোটি টাকা।
সমিতির সদস্যবৃন্দের আর্থিক বুনিয়াদ আরো সুসংহত করতে চলছে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কার্যক্রম। প্রকল্পের উপজেলা সমন্বয়কারীর কার্যালয় ব্যাংকের কার্যালয় হিসেবে কাজ করছে। সমিতির মোট তহবিল দুই বছরে নয় লাখ টাকা হলে ওই তহবিল স্থানান্তরিত হয় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে। সমিতির সদস্য সমিতি থেকে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন। সমিতি ঋণের সার্ভিস চার্জ আট শতাংশ হলেও ব্যাংক ঋণের সার্ভিস চার্জ মাত্র পাঁচ শতাংশ।
নাটোর সদর উপজেলার দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের গোয়ালদিঘী-কৃষ্ণপুর গ্রাম উন্নয়ন সমিতির একজন সফল উদ্যোক্তা আমেনা খাতুন। সমিতি থেকে প্রায় সাত বছর আগে দশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শুরু করেছিলেন মুড়ি ভাজা ব্যবসা। জেলার বৃহত্তম ডালসড়ক মুড়ির হাটের প্রতিদিনের বিক্রেতা আমেনা খাতুনের ঋণ এখন পঞ্চাশ হাজার টাকা। আর তার মূল মুড়ি ব্যবসায়ের পরিধি বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়িতে হাঁস-মুরগী ও ছাগলের খামার করেছেন। বিয়ে দিয়েছেন চার মেয়ের। আমেনা বেগম বলেন, সমিতি করতে যেয়ে সংসারে শুধু সচ্ছলতাই আসেনি, সচেতনতাও এসেছে। এখন স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করি, বিশুদ্ধ পানি পান করি এবং অন্যদেরও সচেতন করি। একই এলাকার মোবারক হোসেনের ঋণও পঞ্চাশ হাজার টাকা। তিনি বলেন, এই গ্রাম এখন পরিচিতি পেয়েছে মুড়ির গ্রাম হিসেবে।
হালসা ইউনিয়নের বাগরুম গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সফল সদস্য ও ম্যানেজার শরিফুল ইসলাম এখন প্রতিষ্ঠিত লেবু ব্যবসায়ী। দর্শনে উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ করে পাঁচবছর আগে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টায় সমিতি থেকে দশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ১০ কাঠা জায়গাতে লেবু বাগান শুরু করেছিলেন। এখন চায়না-৩ জাতের লেবু বাগানের পরিধি ছয় বিঘা। মাসে বিক্রি করেন গড়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা। শরিফুল বলেন, খরচ বাদে এক বিঘা লেবু বাগান থেকে বছরে দেড় লাখ টাকা মুনাফা অর্জন সম্ভব। পাশাপাশি গাছের কলম করে বছরে লাখ টাকা বাড়তি উপার্জনও করেন। শরিফুলের দেখাদেখি বাগরুম গ্রাম ছাড়িয়ে সমগ্র হালসা এবং পাশের দিঘাপতিয়া, লক্ষ্মীপুর-খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের শতাধিক ব্যক্তি লেবু বাগান করেছেন। এ যেন লেবুর সবুজ বিপ্লব। একই রকম ভেষজ সবুজ বিপ্লব ঘটেছে দেশের একমাত্র ভেষজ গ্রাম লক্ষ্মীপুর-খোলাবাড়িয়া ইউনিয়ন জুড়ে। সমিতির ঋণ নিয়ে চৌরি সমিতির সায়েদ আলীসহ অসংখ্য উদ্যোক্তা সাফল্যগাঁথা তৈরী করে চলেছেন।
আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের গুরুদাসপুর উপজেলা কার্যালয়ের সমন্বয়কারী মোছা. লুৎফুন নাহার বলেন, প্রচলিত বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি উপজেলার পালপাড়া এলাকায় মৃৎশিল্প এবং সোনাবাজু এলাকায় মাছ ধরার খোলসুন তৈরীতে এগিয়ে গেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার সমিতিগুলো।
আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প নাটোর সদর উপজেলার সমন্বয়কারী মো. মাজেদুর রহমান জানান, বিদ্যমান সমিতিগুলোর মনিটরিংসহ প্রকল্পের পরিধি বাড়াতে কাজ করছি আমরা। কিছু-কিছু এলাকায় সমিতির উদ্যোক্তাবৃন্দ এতটাই সফল হয়েছেন যে, ওইসব এলাকায় তাদেরকে অনুসরণ করে একই ধরণের উদ্যোগের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে।
আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের জেলা সমন্বয়কারী মো. নজরুল ইসলাম বাসসকে বলেন, এই প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দরিদ্র্য জনগোষ্ঠির পারিবারিক পর্যায়ের দারিদ্র্যতা নির্মূল হবে। তৃণমূল পর্যায়ের দারিদ্রতা দূর হলে বাংলাদেশ খুব সহজেই পৌঁছে যাবে সমৃদ্ধির সোপানে।