নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের একের পর এক মিলছে বৈশ্বিক স্বীকৃতি

1197

॥ মাহবুব আলম ॥
ঢাকা, ২৮ মে, ২০২০ (বাসস) : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্পিকার-সবাই নারী। সরকারের মন্ত্রিসভাতেও নারী সদস্য রয়েছেন। নারী দায়িত্ব পালন করছেন বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবেও। বর্তমান সরকারের গত এক দশকে নারীর ক্ষমতায়নে অসংখ্য অর্জন রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে নারীর ক্ষমতায়নে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। এসব উদ্যোগের ফলেই বাংলাদেশের নারীর বিজয় পতাকা উড়ছে এভারেস্টের চূড়া থেকে ফুটবল-ক্রিকেট মাঠেও। এজন্য মিলছে একের পর এক বৈশ্বিক স্বীকৃতি।
জানা যায়, বর্তমানে বিচারপতি, সচিব, ডেপুটি গভর্নর, রাষ্ট্রদূত, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মানবাধিকার কমিশনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তর-সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন নারী।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। সরকারি বেসরকারি খাতে তো বটেই, স্থানীয়ভাবেও জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গেও জড়িত হয়েছেন নারীরা।
এর মধ্যে কেউ কৃষিতে, কেউ পোশাক কারখানা কিংবা অনেকেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগে সফলতা অর্জন করে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নারীদের বিভিন্ন কাজের প্রশংসা করেছেন এবং তাদের আত্মমর্যাদা নিয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।
গতবছরের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মেয়েরা যখন কাজ করে, আমি মনে করি, খুব ভালোভাবে করে। তাদের কাজের দক্ষতা অনেক বেশি, এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমি চাই, আমাদের বোনেরা একটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে, আত্মমর্যাদা নিয়ে চলবেন।’
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নারীর উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি তাদের কাজের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতেও কাজ করছে সরকার। এর মাঝে মাতৃত্বকালীন ছুটি তিন মাস থেকে দুই ধাপে ছয় মাস করা, সন্তানের পরিচয়ে বাবার সঙ্গে মায়ের নাম যুক্ত করা, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে পুরুষের পাশাপাশি একজন নারী উদ্যোক্তা থকা নিশ্চিত করা, মেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে ‘তথ্য আপা’ প্রকল্প চালু, নগরভিত্তিক প্রান্তিক মহিলা উন্নয়ন প্রকল্প চালু করা হয়েছে।
এছাড়া, নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ সাধন প্রকল্প, অতিদরিদ্র ১০ লাখ মহিলার দক্ষতা উন্নয়ন ও কারিগরি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া ও প্রদর্র্শনের জন্য নারীবান্ধব বিপণন নেটওয়ার্ক ‘জয়িতা’ গড়ে তোলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, সরকার তৃণমূলের নারীদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অংশগ্রহণমূলক বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। দেশব্যাপী ১২ হাজার ৯৫৬টি পল্লী মাতৃস্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মা ও শিশুর যতœসহ যাবতীয় বিষয়ে উদ্বুদ্ধকরণ ও সুদমুক্ত ক্ষদ্রঋণ দেওয়া হচ্ছে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা বলেন, গ্রামীণ নারীরা যেন কোনোভাবেই পিছিয়ে না পড়ে সে বিষয়টি মাথায় রেখে নানা উদ্যোগ রয়েছে সরকারের। এর মধ্যে তাদের ইনকাম জেনারেটিং কর্মসূচির আওতায় ড্রাইভিং, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন বিষয়ে ১৮টি ট্রেডে বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ভাতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে যাতায়াত ভাতাও পাচ্ছেন প্রশিক্ষণার্থীরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, নারীর ক্ষমতায়ন ও তাদের স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তুলতে যে ১৩ হাজার ৮১২টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে সেখানেও নারী কর্মী নিয়োগ দিয়েছে সরকার। যার ৫৪ শতাংশই নারী। এছাড়া ১ হাজার ৯৩৫ জন নারী সিএইচসিপি (ক্লিনিককর্মী) সিএসবিএ (প্রসূতি সেবা বিষয়ক) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
কমিউনিটি হেলথ কেয়ারে’র লাইন ডাইরেক্টর ডা. সহদেব রাজবংশী বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রশিক্ষিত ক্লিনিককর্মীরা প্রসূতিসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে গ্রামে নিরাপদ সন্তান প্রসব এবং প্রসব-পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলস্বরূপ দেশে মা ও শিশুমৃত্যু হার হ্রাসে সাফল্য এসেছে।
সূত্র জানায়, নারীর ক্ষমতায়নে গত ১০-১১ বছরে সরকার বেশ কিছু আইন-নীতি ও বিধিমালা তৈরি করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, ২০১১, মনোসামাজিক কাউন্সেলিং নীতিমালা, ২০১৬ (খসড়া); জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নকল্পে কর্মপরিকল্পনা, ২০১৩-২০১৫, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০; ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ) আইন, ২০১৪; পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) বিধিমালা, ২০১৩ এবং বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭।
এছাড়া, নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের আওতায় ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রংপুর ও ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) স্থাপন করা হয়েছে।
এসব ওসিসি-তে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজারের মতো নারী ও শিশুকে প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, হাসপাতলের ওসিসি-তে ভুক্তভোগীদের প্রয়োজনীয় সব ধরনের সেবা দেয়া হয়।
এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই সেন্টারে টোল-ফ্রি হেল্পলাইন ১০৯ নম্বরে ফোন করে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু, তাদের পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট সবাই প্রয়োজনীয় তথ্য, পরামর্শসহ দেশে বিরাজমান সেবা ও সহায়তা সম্পর্কে জানতে পারেন।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী রওশন আক্তার জানান, মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাসে উন্নীত এবং মাতৃত্ব¡কালীন ভাতা ও ল্যাকটেটিং মাদার ভাতা চালু করা হয়েছে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়ন এবং নারী উন্নয়ন-সংক্রান্ত ফোকাল পয়েন্ট নির্ধারণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারি চাকরিতে নারী কর্মকর্তার হার ২০২০ সাল নাগাদ ২৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদিকে, নারীর ক্ষমতায়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুরস্কৃত হয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সালে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নারী শিক্ষার উন্নয়ন এবং ব্যবসায়িক উদ্যোগে ভূমিকার জন্য শেখ হাসিনাকে গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘গ্লোবাল সামিট অব উইমেনস’।
এর আগে নারীর ক্ষমতায়নে উদ্যোগ নেওয়ায় ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ ও ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন।
এছাড়া, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহণের মান হিসেবে ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট, ২০১৬’ অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ স্থানে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, নারীর সব ক্ষেত্রে ক্ষমতায়নে ১৪৪ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭২তম, যা দক্ষিণ এশিয়ার যেকোনো দেশের চেয়ে ভাল।
এই বিষয়টাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন মানবাধিকার নেতারা। মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, নারীরা বাইরে বেরিয়ে আসছেন এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদের জন্য ইতিবাচ দিক। তবে, দেশে এখনও যত্রতত্র যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা। এ বিষয়ে পদক্ষেপের পাশাপাশি সবাইকে সচেতন হতে হবে। অন্যথায়, নারীর ক্ষমতায়নের উদ্যেগের সুফল পাবেন না নারী।’