বাসস দেশ-১৩ : হাজেরার স্বপ্ন : সাবেক এক যৌনকর্মীর মহান উদ্যোগ

246

বাসস দেশ-১৩
যৌনকর্মী-শিশুনিবাস
হাজেরার স্বপ্ন : সাবেক এক যৌনকর্মীর মহান উদ্যোগ
ঢাকা, ১৪ জুলাই, ২০১৮ (বাসস) : ৪৭ বছর বয়সী হাজেরা বেগম। পেশায় ছিলেন যৌনকর্মী। নিজ জীবনের গতিপথ ঘুরিয়ে দিয়ে নিলেন এক মহান ব্রত। উদ্যোগ নিলেন সমাজের জন্য ভাল কিছু করার। হয়ে উঠলেন যৌনকর্মীদের অবাঞ্ছিত সন্তানের মা। সমাজে তাদের স্বীকৃতি দিলেন, সমাজের মূল ধারায় এসব শিশুদের সম্পৃক্ত করতে যোগ্য করে গড়ে তুলছেন এদের। এসব শিশুরা বিভিন্ন বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে রাখছে মেধার স্বাক্ষর।
হাজেরার এ পর্যন্ত সন্তানের সংখ্যা প্রায় ১৫০ জন। এসব সন্তানেরা জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার লড়াইয়ে কাজ করে গেলেও মাকে ভুলে না। নিয়ম করে তারা এ পরিবারে আসে এবং সময় কাটিয়ে ফিরে যায় নিজের কর্মস্থলে কেউ কেউ তার ¯েœহেই প্রতিপালিত হচ্ছে।
এসব সন্তান তার ঔরসজাত নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে যৌনকর্মীরা তাদের সন্তানকে নির্ভরতার আশ্রয় হিসেবে তার কাছে রেখে যান। মাসিক আর্থিক খরচ দেয়ার কথা থাকলেও অনেকে আর খোঁজ খবর রাখে না। নি:সন্তান এই নারীকে আশ্রিত শিশুরা যখন ‘মা’ ডাকে তখন তিনি সব কষ্ট ভুলে সকলকে নিয়ে মিলেমিশে থাকেন।
হাজেরার জীবনের গল্প আর পাঁচ জনের মতো নয়, সৎ মায়ের সংসারে মানুষ। ক্ষুধার যন্ত্রণা নিয়েই ঘর পালায় ৭ বছরের হাজেরা। মিরপুরের বাস্তুহারা বস্তি থেকে পালিয়ে বাসে উঠেছিলেন। বাসেই ঘুমিয়ে পড়ে, জানতে পারে গুলিস্তান এটি। ঠিকানা বলতে না পারায় ফিরে যাওয়া হয়না পরিবারের কাছে। ময়লাÑআবর্জনা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসপত্র ভাঙ্গারী দোকানে বিক্রি আর পকেটমারের অভিজ্ঞতা নিয়ে জীবন চলতে থাকে তার জীবন। জিপিও এ সামনে থেকে ‘মাড় ভাত’ খেয়ে টিকে থাকা হাজেরা সেসময় জেলে বাবার খোঁজ আর পায়নি। মাঝে মাঝে ভবঘুরে থাকার অপরাধে পুলিশের গাড়িতে করে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া, ভেসে বেড়াতে বেড়াতেই ১০ বছর বয়সে বিক্রি হয়ে যায় নিজের অগোচরে। এরপর ঠিকানা হয় এক ‘মাসী’র কাছে। পতিতাবৃত্তির জীবন। কান্দুপট্টি থেকে টানবাজার। জীবনের সমীকরণে মাঝে অনেক বছর চলে যাওয়া। এরপর ভাসমান পতিতা হিসেবেই কাটান।
বিয়ে হলেও বেশিদিন আর সংসার করা হয় না হাজেরার। ফিরে আসেন পুরানো পেশায়। পোশাক তৈরির কারখানায়ও কাজ করেন কিছুদিন। বেসরকারি সংস্থা ‘কেয়ার বাংলাদেশে’ কাজ নিলেন। সংগঠনের মাধ্যমে লেখাপড়া ও হাতের কাজ শেখেন। এসময় এইচআইভি এইডস এর প্রকল্পে সচেতনতা তৈরি করতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়েছেন, প্রায় ১২টি দেশে ভ্রমণ করেছেন।
পরে ‘দূর্জয় বাংলা’য় ‘চাইল্ড কেয়ার সেন্টারে।’ ভাসমান যৌনকর্মীদের সন্তানদের দেখভালের কাজ পেয়ে যান তিনি।’ একসময় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলেও এসব শিশুদের মায়া ভুলতে পারেন না তিনি। জীবনের শেষসম্বল দিয়ে দুজন সহায়তাকারী, একজন শিক্ষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু স্বেচ্ছাসেবক এর স্বেচ্ছাশ্রমে ২০১০ সালে নিজ উদ্যোগে সাভারের উত্তর রাজাসনে ২০ জন শিশু নিয়ে ‘শিশুদের জন্য আমরা’ এই নামে একটি সংগঠন করেন তিনি। পরে ২০১১ সালের মাঝামাঝি থেকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় সুনিবিড় হাউজিং সোসাইটিতে তার কার্যক্রম চলে।
হাজেরা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে রাস্তায় ছিলাম। দেখতাম যৌনকর্মীদের বাচ্চা চুরি হয়, অনেকে তাদের মায়ের আদিম পেশায় ফিরে যায়। রাস্তায় বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়, স্বপ্ন দেখতাম এসব শিশুদের জন্য কিছু করার জন্য। বিদেশে যখন গিয়েছি সেসময় যতটুকু পেরেছি তা জমিয়ে রেখেছি। পরে এসব টাকা দিয়ে দুই বছর কারো সাহায্য ছাড়াই সংগঠনের কার্যক্রম চালিয়ে গেছি। সমাজ সচেতন কিছু মানুষ এই শিশুনিবাসটিকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, সবসময় যৌনকর্মীদের সমাজে হেয় করে দেখা হয়, তাদের সন্তানদেরও পিতৃ পরিচয় থাকে না। আমি আমার বাবার নাম দিয়ে এসব শিশুদের ভর্তি করাই। কারো কারো নাম দেই আমাদের ভলান্টিয়ারদের নামে। এসব শিশুরা আমার পরিচয়ে মানুষ হচ্ছে। আগে এসব শিশুদের ভর্তি করাতে অনেক সমস্যা হতো। এখন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হয়েছে। যদি সরকারি সহযোগিতা পাওয়া যায় তাহলে এসব শিশুদের আরো এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।’
হাজেরা বলেন, এসব শিশুরা প্রাইমারী ও হাইস্কুলে পড়ালেখা করছে। প্রতি সপ্তাহে দুদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবক দলটি এসে পড়িয়ে যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজয়ানা চৌধুরী বন্যার গানের স্কুল সুরের ধারায় ৮ জন শিশু গান শিখতে যায়। এছাড়া অবসরে এদের সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্ত করা হয়। এদেও তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্ম নিয়ে শিগিরই একপি প্রদশর্নী করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এই সংগঠনের সেচ্ছাসেবক সামিউল হাসান রঞ্জু বলেন, হাজেরা বেগমের স্বপ্ন পূরণে অনেকে যেমন এগিয়ে এসেছেন তেমনি অনেক মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে তাকে হেয় করেছে। কাজে বাঁধা দিয়েছে। কিন্তু আমরা এই সংগঠনের শুরু থেকেই তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি।
সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশু স্বপন। আখাউড়া থেকে এই শিশুটিকে আহত অবস্থায় দূর্জয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন একজন। কয়েকদফা চিকিৎসার পর সুস্থ এই শিশুটিকে নিয়ে তিনি বলেন, ওর বাবা মার পরিচয় পাওয়া যায়নি। কিন্তু তার জন্য আমার ¯েœহ ও ভালোবাসা আরো বাচ্চাগুলোর মতই। বুকে জড়িয়ে আদর করতে করতে বলছিলেন হাজেরা।
জীবনে অর্জন কি তা জানতে চাইলে হাজেরা বলেন, অনেকে বড় হয়ে তাদের মায়ের কাছে ফিরে গেছে। আবার অনেকে নিজের মতো জীবন খুঁজে নিয়েছে। এদের অনেকে বেড়াতে আসে, মা দিবসে কেউ চিঠি লিখলে, খোঁজখবর নিতে অনেকে- এসবই অর্জন, মনটা জুড়িয়ে যায়।
এই শিশুনিবাসের বাসিন্দা রমজান, আকাশ, সাইদ রবিন, রাহাত এরা নবম ও দশম শ্রেণিতে পড়ছে। অন্যরা সকলে প্রাইমারিতে পড়ছে স্থানীয় বিভিন্ন বিদ্যালয়ে।
দশম শ্রেণির ছাত্র সাইদ জানায় লেখাপড়া শিখে দেশের জনসাধারণের সেবা করতে মন্ত্রী হতে চায়। অস্টমশ্রেণির শিক্ষার্থী একান্ত একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আর নবম শ্রেণির আকাশ বড় হয়ে পাইলট হবার স্বপ্ন দেখে।
জাতীয় সমাজ কল্যাণ পরিষদের গবেষণা ও প্রকাশনা কর্মকর্তা ওয়াহিদা আক্তার বাসসকে জানান, সরকার বয়স্ক যৌনকর্মীদের আত্মনির্ভরশীল করার সুযোগ করে দেয়ার জন্য কাজ করছে। সাবেক যৌনকর্মীদের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনায় একটি সমীক্ষাও চালানো হয়েছে। সমীক্ষায় সাবেক যৌনকর্মীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দেয়া নিয়ে সুপাারিশও করা হয়েছে।
বাসস/এএসজি/এসএস/১৮০৫/কেএমকে