শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাইকো কাউন্সিলর নিয়োগে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

969

॥ মাহফুজা জেসমিন ॥
ঢাকা, ১৭ মার্চ, ২০২০ (বাসস) : শিশুর মনোদৈহিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন করে সাইকো কাউন্সিলর নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন শিশু মনোবিজ্ঞানী, শিশু অধিকার বিশেষজ্ঞ ও শিশু অধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
তারা মনে করেন, শিশুর সার্বিক সুরক্ষায় তাদের শারিরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দিতে হবে। যা ভবিষ্যতে তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করবে।
আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী হিসেবে এ বছরটিকে মুজিব বর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। শিশুদের কল্যাণে বছরব্যাপী সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। এসব কার্যক্রমের মধ্যেই শিশুদের মানসিক সুরক্ষার দিকে অধিক জোর দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন শিশু অধিকার বিশেষজ্ঞরা।
শিশু কিশোর উন্নয়ন ও মনো-সামাজিক সেবা সংস্থা প্রেরণা’র সাধারণ সম্পাদক শেখ জাদী রেজিনা পারভিন পেশাগত জীবনে একজন সাইকো থেরাপিস্ট। তিনি দীর্ঘদিন ধরে শিশু-কিশোরদের মনোসামাজিক কাউন্সিলিং করছেন।
রেজিনা পারভিন বলেন, পরিবারের পরেই শিশুর শেখার জায়গা হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিশু বয়সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যে শিক্ষা এবং আচরণ তারা শেখে সেটাই নিজের ভেতরে ধারণ করে। তাই, এসময়ে তার মানসিক গঠন ও প্রতিক্রিয়ার দিকে বিশেষ নজর দেয়া উচিত।
তিনি বলেন, ‘শিশুর সুষম মানসিক বিকাশে প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন করে শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। যারা শিশুদের কথা মন দিয়ে শুনবে এবং সঠিক পথ নির্দেশনা দেবে।’
আমাদের দেশের শিশুদের নানারকম সমস্যা রয়েছে। শিক্ষকদের কঠোর শাসন, তাদের কোন সমস্যার কথা শুনতে না চাওয়া, স্কুলে বুলিং, যৌন হয়রানি, অপমান ইত্যাদি শিশুমনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। যা তার মনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিরূপ ধারনা দেয়। পরিবারে বা স্কুলেও সে নিজের কথা বলার জায়গা পায় না বা ভরসা পায় না। এসব পরিস্থিতিতে শিশুরা একা ও উদ্যমহীন হয়ে পড়ে। কারো সাথে মেশে না বা কথা বলে না। কোন কাজে আনন্দ পায় না।
রেজিনা বলেন, এ পরিস্থিতিতে শিশুরা বিপথগামী হতে পারে বা বড় ধরনের কোন ক্ষতির শিকার হতে পারে। পরিবারের বড়দের এই ব্যাপারে নজর রাখতে হবে। আবার শিশুদের কথা শোনার জন্য প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ থাকলে শিশুরা মন খুলে কথা বলতে পারবে। যা শিশু পারিপাশির্^ক পরিস্থিতি সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব দূর করতে সহায়ক হবে।
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ-এর উপ-পরিচালক (এডভোকেসি) সাবিরা সুলতানা নূপুর বলেন, সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম এবং শিশু অধিকার কনভেনশন অনুযায়ী পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শিশুর অধিকার সংক্রান্ত সকল উদ্যোগে শিশুর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তাদের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী শিশুর উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
তারা বলেন, পারিবারিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি ও নির্যাতন, বুলিং ইত্যাদি বিষয় থেকে নিজেকে রক্ষা করার শিক্ষা ও আত্মবিশ^াসও তাদের বিদ্যালয় থেকেই শেখাতে হবে। তবেই তারা ভবিষ্যতের আত্মবিশ^াসী ও সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে।
জাতীয় শিশু ফোরামের সহকারী সম্পাদক ও ঘাসফুল শিশু ফোরামের সভাপতি ঋদ্ধি জাহান দোলা প্রত্যেক বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিশু বান্ধব শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করেন।
দোলা বলেন, শিক্ষকদের দুর্ব্যবহার, অশালীন কথা বা ইঙ্গিত শুনেও আমাদের চুপ করে থাকতে হয়। কারণ, অভিভাবকদের বললেও তারা এটার কোন সমাধান করেন না। আবার স্কুলেও কারো কাছে বলা যায় না। কিন্তু স্কুলে যদি শিশু অধিকার বিষয়ে সচেতন শিশু সংবেদনশীল শিক্ষক থাকেন তাহলে তার কাছে আমরা মন খুলে সমস্যার কথা বলতে পারি এবং পরামর্শ নিতে পারি।
দোলা শিশুর সুষম বিকাশে প্রত্যেক বিদ্যালয়ে বছরব্যাপী খেলার মাঠ, বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ, ছেলে-মেয়েদের জন্য পৃথক ও মানসম্মত ওয়াশরূম, বছরব্যাপি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনার দা্িব জানান। সারাদেশে জাতীয় শিশু ফোরামের ২৩০০ কমিটিতে ৮৮ হাজার সদস্য কাজ করছে।
জাতীয় শিশু ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং ময়নসিংহ বিভাগীয় শিশু ফোরামের সভাপতি অপূর্ব চন্দ সরকার বাসসকে বলেন, শিশু বান্ধব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হলে শিক্ষকদের অবশ্যই শিশু সংবেদনশীল প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেক স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতে শিক্ষার্থীদের দু’জন প্রতিনিধি অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। যারা নিজেদের সমস্যাগুলো একত্র করে ম্যানেজিং কমিটিকে জানাবে। এছাড়াও তিনি প্রত্যেক বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে একটি করে শিশু সুরক্ষা কমিটি গঠন করার সুপারিশ দেন।
অপূর্ব জানান, সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী শিক্ষার্ধীদের সমস্যার কথা জানাতে প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি করে অভিযোগ বাক্স থাকার কথা। যেসব অভিযোগের ভিত্তিতে ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। কিন্তু ময়মনসিংহ বিভাগের বেশির ভাগ স্কুলে দেখা যায় অভিযোগ বাক্স নেই। আবার যে কয়টা স্কুলে অভিযোগ বাক্স রয়েছে সেগুলো প্রধান শিক্ষকের অফিস কক্ষের দরজার সামনে শিক্ষকদের নজরদারিতে থাকে। কেউ সেখানে অভিযোগ ফেলতে সাহস পায় না। ময়মনসিংহ বিভাগে শিশু অধিকার ফোরামের কার্যক্রমের আওতায় ৪৯২ টি হাইস্কুল রয়েছে।
সাবিরা সুলতানা নূপুর বলেন, ‘সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে সরকার অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু একটি শিশুও যদি পারিবারিক, সামাজিক সহিংসতার শিকার হয় তাহলে কাঙ্খিত এ লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে বলা যাবে না।’
মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সময় থেকেই শিশুর শারিরীক ও মানসিক বিকাশ হতে থাকে। আমরা বেশিরভাগ বাবা-মা শিশুদের শারিরীক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিলেও মানসিক কোনো সমস্যা হতে পারে তা ভাবতে পারি না। পরিবারের প্রাপ্তবয়স্কদের আচার-আচরণ, শাসন পদ্ধতি, সামাজিক যোগাযোগ, পারিবারিক সম্পর্ক শিশু মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে, শিশু মনে বড়দের প্রতি একধরনের ভয় বা আস্থাহীনতা কাজ করে। তারা নিজের গভীর সমস্যাটাও অভিভাবকদের বলতে পারে না বা চায় না।
সাইকোথেরাপিস্ট রেজিনা পারভিন বলেন, শিশুর মানসিক বিকাশ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে অভিভাবকদেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উদ্যোগে বাচ্চাদের অভিভাবকদের ডেকে পৃথকভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে।