ধর্ষকদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ ঘোষণা

865

সংসদ ভবন, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা শেখ হাসিনা সন্ত্রাস, মাদক এবং জঙ্গিবাদের মত ধর্ষকদের বিরুদ্ধেও জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করে এসব অপরাধের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষ নামের কিছু পশু ছোট শিশু থেকে শুরু করে মেয়েদের বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণ করছে। এদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ এবং মাদকের বিরুদ্ধে যেমন ব্যবস্থা নিয়েছি তেমনি এখন আমরা সন্ত্রাস,জঙ্গিবাদ, মাদক এবং ধর্ষকের বিরুদ্ধে একইভাবে জিরো টলারেন্স ঘোষণা দিচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা শেখ হাসিনা আজ সন্ধ্যায় একাদশ জাতীয় সংসদের ৬ষ্ঠ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনিত ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনা এবং অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে একথা বলেন। ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এ সময় স্পিকারের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশবাসীকে আমি আহবান করবো- এই ধরনের ঘটনা (ধর্ষণ) যারা ঘটাচ্ছে তাদের ধরতে সকলেই যেন আমাদের সহযোগিতা করেন। কারণ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা আমরা আইনগতভাবেই নেব এবং এ বিষয়ে আমরা যথেষ্ট সচেতন রয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘করোনা ভাইরাস’ প্রতিরোধ, ‘ডেঙ্গু’ প্রসংগ, আসন্ন রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং দেশের ব্যাংকে টাকা নেই বলে বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে দেশের বর্তমান রিজার্ভসহ আর্থ-সামাজিক অবস্থার উত্তরণের চিত্র তাঁর ভাষণে তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার চাচ্ছে দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তা যেন চলমান থাকে। চলার পথে নানা সময় বিভিন্ন সমস্যা দেখা গেলে সরকার তাৎক্ষনিকভাবেই সেটা সমাধানের উদোগ গ্রহণ করে।
প্রধানমন্ত্রী করোনা ভাইরাস প্রসঙ্গে বলেন, এটা যখন চীনে দেখা দেয় তখনই তাঁর সরকার এ বিষয়ে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে এবং অন এরাইভাল ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে।
তাঁর সরকারের বিমানবন্দরে প্রতিরোধমূলক সতর্কাবস্থা গ্রহণের প্রসংগ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চীন বা যেসব দেশে এই ভাইরাস দেখা গিয়েছে সেসব দেশ থেকে কেউ আসলে তার সঠিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমরা নিশ্চিত হচ্ছি এই ভাইরাস নিয়ে কেউ ঢুকছে কিনা। কাউকে এতটুকু সন্দেহ হলে হাসপাতালে নিয়ে তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোয়ারান্টাইনে রেখে তারপর আমরা ছাড়ছি।’ তিনি বলেন, ‘এটা যেন বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করতে না পারে সেজন্য যথাযথ ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি।’
অতীতে দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার প্রসংগ টেনে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে বাড়ি-ঘর এবং চারপাশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে এই রোগ সৃষ্টিকারি এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধ করার বিষয়েও সবাইকে পুনরায় সতর্ক করেন।
তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ে একটা সমসা সৃষ্টি হয়েছিল। আবারও মশার উপদ্রব বাড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমি দেশবাসীকে বলবো নিজেদেরকেও একটু সচেতন থাকতে হবে এবং বাড়ি-ঘর পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, যেন মশা না জন্মাতে পারে সে ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে আসন্ন রমজান মাসে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সমাগ্রীর সরবরাহকে সুষম রাখার মাধ্যমে দ্রব্যমূল্যকে জনগণের নাগালের মধ্যে রাখার জন্যও সংশ্লিষ্ট মহলকে নির্দেশনা প্রদান করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সামনে রোজা আসছে। আমি জানি রোজার সময় সবসময়ই দ্রব্যমূল্য নিয়ে একটা খেলা শুরু হয়। হঠাৎ কোন জিনিসের দাম বাড়ে আবার কমে। পেঁয়াজ নিয়ে যেমন একটা সমস্যা হয়েছিল।
রোজার সময় আমাদের কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে আকর্ষণ তৈরী হয় উল্লেখ করে তিনি সেগুলো এখনই টিসিবি’র মাধ্যমে ক্রয় ও মজুদের পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি সরবরাহ সঠিক রাখতে তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন।
‘ছোলা’, ‘চিনি’, ‘তেল’, ‘পেঁয়াজ’,‘রসুন’ বাজারে সরবরাহ সঠিক রাখার পাশাপাশি এগুলো উৎপাদন বৃদ্ধিতে তাঁর সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘কেউ কোন ধরনের গুজবে আতঙ্কিত হবেন না।’
অতীতে এ ধরনের গুজবে আতংকিত হয়ে অতি উৎসাহী জনগণ নানা সমস্যার সৃষ্টি করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘ভয়ে একবারে বেশি কিনে নিজেরা যেন লোকসানে না পড়েন, সেটাও একটু সবাইকে দেখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘কোথায় কি আছে না আছে আমরা তা দেখে আমাদের চাহিদা এবং প্রয়োজন নিরুপন করে আমরা এ বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছি। তবে সমস্যা হচ্ছে চীন থেকে আমাদের যে কাঁচামাল আসতো সেগুলোর বিষয়ে আমরা যথেষ্ট সতর্ক এবং এর জন্য আমরা বিকল্প খুঁজছি।’
এগুলো আমদানির বিকল্প পথ তাঁর সরকার নিচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল যে দামেই হোক আমরা অন্য দেশ থেকে আনার চেষ্টা করছি। এখানে আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ আছে বলে আমি মনে করিনা।
দেশে এখন রিজার্ভের পরিমাণ ৩২ বিলিয়ন ডলারের ওপরে রয়েছে উল্লেখ করে সংসদ নেতা বলেন, ‘আপদকালিন ৩ মাসের খাদ্য ক্রয় করার সক্ষমতা অর্জনের জন্যই রিজার্ভ রাখা হলেও আমাদের যে পরিমাণ রিজার্ভ রয়েছে তাতে ৬ মাসের আপদকালিন খাদ্য ক্রয় করার পরও আমাদের কোন সমস্যা হবেনা।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘টাকার কোন অসুবিধা ব্যাংকে নেই, সেটা আমরা বলতে পারি। বরং, ইতোমধ্যেই ১৮ বিলিয়ন ডলার আমাদের রেমিট্যান্স এসেছে। আমাদের সেবা খাত এবং সামাজিক নিরাপত্তা সহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে।’
‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ বড়, সিঙ্গাপুর ছোট একটি দেশ, বিরোধী দল নেই, শৃঙ্খলার মধ্যে চলে, রাজনৈতিক পরিবেশ ভালো। আমাদের দেশে সন্ত্রাস অগ্নি-সন্ত্রাস খুন-খারাবি হয় অনেক কিছুই মোকাবেলা করতে হয়।’
’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যখনই যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা আওয়ামী লীগকে নির্যাতন করেছে। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় থাকতে ’৮৮ সালে আমাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে। অগ্নিসন্ত্রাস করে শত শত মানুষকে হত্যা করেছে। এসব বৈরি অবস্থা মোকাবেলা করে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। ’
তিনি আরও বলেন, ‘কেউ আমাদের উন্নয়ন না দেখলে তা তাদের দেখার ভুল। গ্রাম পর্যায়ে পর্যন্ত দেশের মানুষ অর্থনৈতিক অগ্রগতির সুফল ভোগ করছে।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের সময়ে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতা হত্যাকান্ডের বিচার ও সাজা প্রদান এবং চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রসংগ উল্লেখ করে বলেন, ‘কারো প্রতি বিদ্বেষ নিয়ে চলি না। প্রতিশোধ নিতেও যাইনি। যেখানে অন্যায় হয়েছে, সেখানে ন্যায় করার চেষ্টা করেছি।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এটি আজ কারো কাছে গোপন নেই। এক সময় দেশে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের রাজত্ব ছিল। মানুষের জানমালের কোন নিরাপত্তা ছিল না। আমরা অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলাম। এক দশকে আমরা বাংলাদেশের অবস্থার পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছি।’
শেখ হাসিনা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা এবং কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে বিনা জামানতে উদ্যোক্তা তৈরীতে তাঁর সরকারের ঋণ সুবিধার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘অনেকে বিপুল টাকা খরচ করে বিদেশে যায়। কিন্তু চাকরির গ্যারান্টি নেই। যারা ভুল পথে যায়, দালালের খপ্পরে পড়ে তারাই বিপদে পড়ে। এতো টাকা খরচ করে বিদেশে না গিয়ে দেশেই বিনিয়োগ করে একেক জন কর্ম উদ্যোক্তায় পরিণত হতে পারে। ’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ৩০ মিনিটের কিছু বেশি সময়ের ভাষণে সংসদে রাষ্ট্রপতির দেয়া ভাষণের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘অনেক কষ্ট, ব্যথা-বেদনা বুকে চেপে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশের মানুষ যেন একটু সুখের মুখ দেখে, তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে- সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে চলেছি।’
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে মুজিববর্ষকে সামনে রেখে দেশের চলমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে দেশবাসীর সহযোগিতাও কামনা করেন তিনি।