শীতের পিঠা বানিয়ে স্বাবলম্বী নাছিমা

2038

ঢাকা, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ (বাসস) : গেলবার যখন শেষ সম্বল ভিটেবাড়িতে সর্বনাশা পদ্মা ভাগ বসালো, সেবছরই একমাত্র ছেলে রূপচাঁনকে নিয়ে কাজের সন্ধানে রাজধানীতে পাড়ি জমান চল্লিশোর্ধ্ব নাছিমা বেগম। সঙ্গে এলেন হার্টের রোগী স্বামী আবদুল আলীও।
এলাকার এক পরিচিত জনের মাধ্যমে তারা প্রথম এসে ওঠেন রাজধানীর ভাটারা থানার ছোলমাইদ এলাকার একটি বস্তিতে। এরই মাঝে বুয়ার কাজ পেয়ে যান রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায়। তাকে বেতন দেওয়া হতো ১০ হাজার টাকা।
স্বামী আলীও মাঝে মাঝে টুকটাক কাজ করেন। তবে অসুস্থ হওয়ায় ভারি কোনো কাজ করতে পারেন না। বেশির ভাগ সময় ঘরে বসেই কাটে তার।
কিন্তু টাকা-পয়সা জোগাড় না হওয়ায় ছেলে সালমান মিয়াকে স্কুলে ভর্তি করা হয়নি। ছেলে কাজ নেয় স্থানীয় একটি রিকসার গ্যারেজে। বাসায় বুয়ার কাজের বেতন থেকে কিছু টাকা জমিয়ে ১০ হাজার টাকায় গতবছরে এ্যাপোলা হাসপাতালের পেছনে ছোলমাইদ বাজারে ভাঁপা পিঠার দোকান দেন নাছিমা। তাকে সহযোগিতা করেন স্বামী আলী, রিকশার গ্যারেজে কাজের অবসর সময়ে ছেলে সালমানও ।
গতবছর শীত মৌসুমে পিঠা বিক্রি করে তার চল্লিশ হাজার টাকা আয় হয়। এই টাকা দিয়ে স্বামী আলীকে পান-সিগারেট ও চায়ের ভাসমান দোকান করে দিয়েছেন তিনি। আলী বসুন্ধরা গেট, ছোলমাইদ এলাকায় ঘুরে ঘুরে পান-সিগারেট-চা বিক্রি করে দিনে গড়ে ৫-৭শ’ টাকা আয় করেন।
এ টাকা দিয়ে চলে তার সংসার। তবে এবার একটু বড় করেই ছোলমাইদে পিঠার দোকান খুলেছেন নাছিমা। প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলে তার পিঠার ব্যবসা।
সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় নাছিমার সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন তিনি ব্যস্ত ভাঁপা পিঠা ও চিতই পিঠা তৈরিতে। এর ফাঁকেই এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, দিনে আড়াইশ থেকে তিনশ’ পিঠা বিক্রি হয়। গড়ে খরচ বাদে ৮শ’ টাকার মতো দৈনিক থাকে।
গ্রামে এখনও এই ঐতিহ্য রয়ে গেলেও ব্যস্ত নাগরিক জীবনে ঘরে ঘরে পিঠা বানানোর সময় পাওয়া দুষ্কর। যেহেতু শীতের বেলায় ধোঁয়া ওঠা পিঠা সবাই খেতে চায় এবং শহুরে মানুষকে সেই দিতে নাছিমার মতো অনেকেই পিঠার ব্যবসা করেন।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় শীত মৌসুমে পিঠা বিক্রি করে সাবলম্বী হয়ে ওঠেছে হত-দরিদ্র পরিবার।
শহরের অলিতে-গলিতে, প্রধান-প্রধান মোড়, জনাকীর্ণ রাস্তার ধারে, বাসস্ট্যান্ড, বিপণি বিতানের সামনেসহ নানা জায়গায় জমে ওঠে এসব পিঠার অস্থায়ী দোকান।
নদী ভাঙনের শিকার নাছিমাও তাদেরই একজন। নাছিমার ভাষ্য, সন্ধ্যা হতেই ক্রেতারা ছুটে আসেন পিঠার দোকানে। শীতের জুবুথবু হয়ে চুলার পাশে আগুন পোহানোর পাশাপাশি চলে তাদের পিঠা খাওয়া।
জানালেন, তার বেশির ভাগ ক্রেতা বসুন্ধরা এলাকার রিকশাওয়ালা। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা পরিবার-পরিজন রেখে কাজে ছুটে ঢাকায় এসেছেন।
শীতে গ্রামাঞ্চলে পিঠা-পুলির আয়োজন হয়ে থাকে, কিন্তু নি¤œ আয়ের এসব মানুষের ভাগ্যে তা জুটে না। তাই তার কাছ থেকে অনেকেই পিঠা খেয়ে সেই কষ্ট ভুলে যায়।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার একটি গ্রামের অধিবাসী নাছিমা বলেন, আমরা গরিব মানুষ। এতো কিছু বুঝি না। পেটের দায়ে কিছু তো করতে হবে, তাই করি। এইখান থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার কোনোমতে চলে।
আলাপ-চারিতায় জানালেন, প্রতিদিন তিনি ১২ কেজি চালের গুড়া, ৫/৬ কেজি খেজুরের গুঁড় ও চারটা নারকেলের প্রয়োজন হয় তার। প্রতি পিছ ভাঁপা পিঠা ১০ টাকা করে বিক্রি করা হয়। আর চিতই পিঠা বিক্রি হয় পাঁচ টাকায়।
চালের গুঁড়া, গুঁড়, নারকেল ও লবণের মিশ্রণ করা হয়। এরপর চারটি চুলায় চলে পিঠা তৈরি। এখান থেকে দৈনিক লাভ হয় গড়ে ৮শ’ টাকা।
নাছিমার স্বামী আবদুল আলী বলেন, শীতকালে পিঠার ব্যবসাটা লাভজনক হওয়ায় বছরের এই সময়টায় অনেকেই করে। এতে সংসারেও বাড়তি আয় যুক্ত হয়।
‘এবারের পিঠা বিক্রিতে গতবারের চেয়ে আরও ভালো আয় হবে বলে আশা করছি। আর তা হলে স্থায়ীভাবে চায়ের দোকান দেবো। তখন বউকে আর অন্যেও বাসায় কাজ করতে হবে না।’
তবে নাছিমা বলছেন, স্বামীকে একটি স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করে দিয়ে তিনিও আরও কয়েকবছর বুয়ার কাজ করবেন। এরপর গ্রামে গিয়ে একখন্ড জমি কিনে সেখানেই থাকতে চান তারা।