রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সরকার মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রেখেছে : প্রধানমন্ত্রী

782

সংসদ ভবন, ৪ জুলাই, ২০১৮ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের নিজ মাতৃভূমিতে নিরাপদ, সম্মানজনক ও স্থায়ী প্রত্যাবাসনের জন্য সরকার মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রেখেছে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার শুরু মিয়ানমারে এবং সমাধানও মিয়ানমারকেই করতে হবে। এজন্য রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমারের সাথে চুক্তি হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থাকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আজ সংসদে তাঁর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকারি দলের সদস্য নূরজাহান বেগমের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। দেশের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তাদের সকল মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সর্ব প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, এর মধ্যে গত বছর ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ ও জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি মিয়ানমার সরকারের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতনের কারণে বিভিন্ন সময়ে তারা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি জাতিসংঘে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে পাঁচ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেছি, যা আন্তর্জাতিক মহল সাদরে গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন দেশ এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতনে প্রদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও শুরু থেকে বেশ জোরালো ভূমিকা পালন করেছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও সহায়তা প্রদান করায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের প্রশংসা করা হয়েছে। কৃতজ্ঞতার সাথে আমাদের ভূমিকার স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) ৪৫তম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের তৃতীয় ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউ (ইউপিআর) এবং কানাডায় অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জি-৭ সম্মেলনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। এছাড়া, বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরা এ সময়ে বাংলাদেশ সফর করেন। তারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, গত ১ থেকে ২ জুলাই জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলার জন্য বাংলাদেশে আসেন। এ সময় তাঁরা রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি সরেজমিনে পরিদর্শন করার জন্য কক্সবাজার সফর করেন। জাতিসংঘের মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির অনুরোধ জানানো হয়।
তিনি বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল এ বছর ২৮ থেকে ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসমূহ পরিদর্শন করেন। এ প্রতিনিধি দল মিয়ানমার সফর করে মিয়ানমারের সরকারি প্রতিনিধি দলের সাথেও বৈঠক করেন। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের পক্ষে তারা জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেন। এ সফরের পর গত ৯ মে নিরাপত্তা পরিষদ একটি প্রেসিডেন্সিয়াল প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা দেয়ার জন্য বাংলাদেশের সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। এছাড়া গত ১৪ মে এ সফর নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদেও একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, ওআইসিভুক্ত দেশসমূহের উদ্যোগে গত বছর ১৬ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে ‘সিসুয়েশন অব হিউম্যান রাইটস ইন মিয়ামনার’ নামক একটি রেজ্যুলেশন গৃহীত হয়েছে। এ রেজ্যুলেশনের পক্ষে ১৩৫ ভোট এবং বিপক্ষে ১০টি ভোট পড়ে। কোন নির্দিষ্ট দেশের ওপর গৃহীত রেজ্যুলেশনের ক্ষেত্রে ২০১১ সারের পর একটি সর্বোচ্চ ‘হ্যাঁ’ ভোট প্রাপ্তির রেকর্ড। গত বছর ২৪ ডিসেম্বর এ রেজ্যুরেলশনটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। এ রেজ্যুলেশনের ভিত্তিতে গত ২৬ এপ্রিল জাতিসংঘ মহাসচিব সুইজারল্যান্ডের ক্রিসটিন বার্গনারকে মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, গত বছর ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে ‘মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শিরোনামে একটি বিশেষ সভা আয়োজন করা হয়েছে। এ বিশেষ সভায় রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির মানবাধিকার পরিস্থিতি’ ’ নামে একটি রেজ্যুলেশন গৃহীত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনের সাইড লাইনে অনুষ্ঠিত ওআইসি কন্টাক্ট গ্রুপের সভায় রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান এবং তাদেরকে নিরাপদে নিজ দেশে প্রত্যাবাসনে আমি মুসলিম বিশ্বসহ আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা কামনা করি। এবছর ৫ থেকে ৬ মে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওআইসি’র পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতনের নিন্দা জানিয়ে ‘মিয়ানমারে মুসলিম সম্প্রদায়ের অবস্থা’ নামে একটি রেজ্যুলেশন গৃহীত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর মানবতা বিরোধী অপরাধের দায় নির্ধারণ ও বিচারের জন্য গাম্বিয়ার নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি মন্ত্রী পর্যায়ের এডহক কমিটি গঠন করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশসমূহের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তাদের উপরে সুনির্দিষ্ট অবরোধ আরোপের বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন।