শিশুশ্রম আইন ও নীতিমালা সম্পর্কে শ্রমজীবী শিশু ও তাদের পিতা-মাতার ধারণা নেই

1084

ঢাকা, ২৫ নভেম্বর, ২০১৯ (বাসস) : ট্রান্সপোর্ট ও গৃহকর্মে নিয়োজিত বেশিরভাগ শ্রমজীবী শিশু এবং তাদের পিতা-মাতার শিশুশ্রম সম্পর্কিত আইন ও নীতিমালা সম্পর্কে তেমন কোনও ধারণা নেই।
তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র মোহাম্মদ শরীফ লেগুনায় কাজ করে দৈনিক ২০০ টাকার মত আয় করে মা-বাবার সংসার চালায়। স্কুলেও যায় আবার লেগুনায় ও কাজ করে। শরীফ ৪ ভাই-বোনকে সাথে নিয়ে বাবা-মা’র সংসারে সহযোগিতা করে। মাসে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা আয় হয়। যা দিয়ে মায়ের ওষুধ কেনা, আবার বাবাকেও সহযোগিতা করতে হয় শরীফকে। কিন্তু সে এবং বাবা-মা কেউই জানতো না শিশুশ্রম আইনগত নিষিদ্ধ। পরে একদিন লেগুনায় যাতায়াতের সময় একজন তাকে বলে, ‘তুমি লেখাপড়া বাদ দিয়ে লেগুনায় কাজ কর কেন?’ এই কথায় সে বলে, বাবা-মাকে সহযোগিতা করি। তারা অসুস্থ্য তাই কাজ করি। এমনি করে তার মতো আরো অনেক শিশুই এভাবে কাজ করে বলে সে জানায়।
শিশু অধিকার নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এডুকো’র এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানা যায়, রাজধানীর পরিবহন ক্ষেত্রে শিশুদের বেশিরভাগ রাজধানী ঢাকার শহরে ৩১টি রুট চলাচলকারী হিউম্যান হলারে কাজ করে থাকে। ঢাকায় ৩১টি রুটে প্রতিদিন ১ হাজার ৬শ’ ৪২টি হিউম্যান হলার চলাচল করে। এসব হিউম্যান হলারে ১ হাজার ৬৮জন শিশু শ্রমিক কাজ করছে থাকে। এদের অধিকাংশই শিশু শ্রম সম্পর্কিত আইন ও নীতি সম্পর্কে জানে না। তবে বেশীরভাগ নিয়োগকর্তা শিশুশ্রমের নেতিবাচক বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও এসব শিশুদেরকে ঝূঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করেন।
পরিবহন ক্ষেত্রে ৬৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ শিশু পরিবহন শ্রমিক প্রায়ঃশই তাদের নিয়োগকর্তা এবং যাত্রীদের কাছ থেকে নিগৃহীত হয়। ৬৪ দশমিক শুণ্য ৪ শতাংশ শারীরিক আঘাতের ঝুঁকিতে রয়েছে এবং ৩৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ হতাশায় ভুগছে বলে এডুকো’র এক গবেষণায় জানা যায়। এতে দেখা যায়, পরিবহন ক্ষেত্রে শিশুদের বেশিরভাগ ঢাকা শহরে হিউম্যান হলার-এ কাজ করতে দেখা যায়।
গবেষণায় বলা হয়, যেহেতু প্রাপ্ত বয়স্ক কর্মী নিয়োগ করা ব্যয় বহুল এবং অনেক সময় দুষ্প্রাপ্য, তাই তারা শিশুদেরকে গৃহকর্মে নিয়োগ করেন। ট্রান্সপোর্ট ও গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের নিয়োগকারীরা মনে করেন, যেহেতু এসব শিশু অতি দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে তাই তাদের এ উপার্জন তাদের পরিবারের জন্য সহায়ক। শিশুরা যাতে ঝূঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন এডুকো’র গবেষণা কর্মকর্তা আফজাল হোসেন।
তিনি বলেন, লেগুনাসহ পরিবহণে কাজ করছে এমন শতকরা ৩৫ দশমিক ৫১ ভাগ শিশু মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এছাড়া ৬৮ দশমিক ৪৯ ভাগ শিশু তাদের নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে বকুনির শিকার হচ্ছে এবং ১৭ দশমিক ১৪ ভাগ শিশু শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলে গবেষণা তথ্যে জানা যায়।
এতে আরো দেখা যায়, শতকরা ৫৮ দশমিক ৭৩ শিশু গৃহকর্মী কখনও স্কুলে যায়নি এবং ৮২ দশমিক ৬৮ ভাগ শিশু পরিবহন শ্রমিক কখনও স্কুলে যায়নি। শতকরা ৮৩ দশমিক ৬৫ শিশু গৃহকর্মী এবং ৬৯ দশমিক ৩৮ভাগ শিশু পরিবহন শ্রমিকের ওপর এ গবেষণা করা হয়। যাদের বয়স ছিল ৮ বছর থেকে ১৩ বছরের মধ্যে।
গবেষণায় জানা গেছে যে, বেশিরভাগ শ্রমজীবী শিশু এবং তাদের পিতামাতার শিশুশ্রম সম্পর্কিত আইন ও নীতিমালা সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। তবে, বেশিরভাগ নিয়োগকর্তাদের শিশুশ্রম সম্পর্কিত আইন ও নীতি সম্পর্কে ধারণা আছে। এতে দেখা যায়, শ্রমিকরা নিকটবর্তী কারিগরি বিদ্যালয়ের অনুপস্থিতির কারণে কোনও প্রযুক্তিগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে পারছে না। গবেষণায় শ্রমজীবী শিশুদের পিতামাতাকে সহায়তা করছে এমন কোনও কর্মসংস্থান বা উপার্জনমূলক উদ্যোগের সন্ধান পাওয়া যায়নি। শিশু পরিবহন শ্রমিকের সঠিক স্বাস্থ্যসেবার ধারণা নেই। তারা অসুস্থ হয়ে পড়লে স্থানীয় ফার্মেসির প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ কিনে থাকে।
সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী মুজিবুল হক এমপি বলেন, শিশুশ্রম নিরসন করার জন্য আমাদের নিজেদের ঘর থেকে কাজ শুরু করতে হবে। শুধুমাত্র আইন ও নীতিমালা দিয়ে শিশুশ্রম বন্ধ করা যাবে না, এজন্য নীতি নির্ধারক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যসহ সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের ইতিবাচক মানসিক পরিবর্তন প্রয়োজন।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জাতীয় মহিলা শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি শামসুন নাহার ভুঁইয়া এমপি বলেন, সরকার ২৮৪ কোটি টাকার শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্প খুব শিগগিরই শুরু হবে। এতে এক লাখ শিশুকে ঝূঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে প্রত্যাহার করা হবে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে ১৮টি খাতে ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪ শিশু শ্রমিক রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৭ লাখ ৪৫ হাজার ৬৯০ জন মেয়ে শিশু শ্রমিক।
তিনি বলেন, শিশু শ্রমে নিয়োজিতদের ৫৭ শতাংশের কাজই অস্থায়ী। এদের মধ্যে শিশু শ্রম বেশি কৃষি ও কল-কারখানায়। সেখানে ১০ লাখের বেশি শিশু কাজ করে। এছাড়া দোকানপাটে ১ লাখ ৭৯ হাজার, নির্মাণ শিল্পে ১ লাখ ১৭ হাজার শিশু কাজ করে। বর্তমানে শিশুশ্রমে নিয়োজিত আছে এমন ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু এক সময় স্কুলে গেলেও এখন আর যায় না। আর ১ লাখ ৪২ হাজার শিশু কখনোই স্কুলে যায়নি বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার আইএলও’র তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু নানাভাবে শ্রম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি শিশু নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। বাংলাদেশে শিশু শ্রম নিরসনে সরকারের উদ্যোগ দেশ-বিদেশে বেশ প্রশংসিত হয়েছে।
শিশু অধিকার বিষয়ে অভিজ্ঞ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস বলেন, যদি আমরা আইনী কাঠামো, প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ বৃদ্ধি, অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি, তাহলে সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসন করা অবশ্যই সম্ভব।
শিশু অধিকার নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এডুকো’র কান্ট্রি ডাইরেক্টর জনি এম সরকার বলেন, সরকার এবং এনজিওদের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে শিশুশ্রমিকদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।