একাত্তরের পঁচিশে মার্চ গণহত্যার ওপর স্থাপনা শিল্প প্রদর্শনী শুরু

755

ঢাকা, ২৫ মার্চ, ২০১৮ (বাসস) : ক্যাম্পে ও বধ্যভূমিতে পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা বাঙালিদের হত্যা করছে। লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে চলছে গণহত্যা। নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সের শত শত মানুষের লাশ পড়ে আছে এলোপাথারিভাবে। হাত-পা বেধে, কাপড় দিয়ে মুখ বেধে অসংখ্য মানুষকে ফেলে রাখা হয়েছে সেনা ক্যাম্পে। সেখান থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। বর্বরোচিতভাবে মানুষগুলোকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করছে পাক সেনারা।
এই চিত্রটি ফুটে উঠেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত ‘৭১ এর বর্বরতা ’ শীর্ষক স্থাপনা শিল্প প্রদর্শনীতে। এই স্থাপনা শিল্প প্রদর্শনী আজ শুরু হয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে। মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যা বিষয়ে এতো বড় মাপের ভাস্কর্য প্রদর্শনী দেশে এটাই প্রথম।
আজ শিল্পকলা একাডেমিতে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জমান নূর এমপি এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ ও শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় পাঁচ দশক হতে চলেছে। এতকোল পর পঁচিশে মার্চের গণহত্যার ওপর এই প্রদর্শনী হচ্ছে। এ প্রদর্শনী দেশে যারা মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর গণহত্যার ভুল তথ্য দেয় সেই অসভ্যতাকে মুছে ফেলবে। তিনি বলেন,পাকবাহিনী ২৫ মার্চ যে গণহত্যা করেছে,এই বর্বরতার তথ্য এখন বিশ্ববাসী জানে। অথচ কিছু সংখ্যক স্বাধীনতাবিরোধী এই হত্যা সম্পর্কে মানুষকে ভুল বুঝায়,যা স্বাধীনতার বিরোধীতারই সামিল।
লিয়াকত আলী লাকী বলেন,একাত্তরের ২৫ মার্চ পাক বাহিনী ঢাকাতে লক্ষাধিক বাঙালিকে হত্যা করেছিল। নয় মাসে সারাদেশে পাক বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার চিত্র বর্তমান প্রজন্মকে অবগত করার জন্যই এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। এতে শিল্পী মিন্টু দে’র সাড়ে নয়শত ভাস্কর্য প্রদর্শিত হচ্ছে। দেশে এ বিষয়ে এটাই প্রথম প্রদর্শনী।
মহাপরিচালক আরো বলেন, ২৫ মার্চের ভয়াবহতা ও আত্মোৎসর্গ বাঙালি কখনও ভুলতে পারবে না। শুধু লেখার মাধ্যমে তা তুলে আনা সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধ যেমন একটি জনযুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত তেমনি মুক্তিযুদ্ধের উপস্থাপনাতে গণমানুষের অংশগ্রহণও অনিবার্য বিষয়। তাই ৭১-এর লোমহর্ষক ঘটনার উপস্থাপন স্থাপনাশিল্পের (ইন্সটলেশন আর্ট) মাধ্যমে মানুষের কাছে স্পষ্ট ও সহজ করে তুলে ধরা বাস্তব সম্মত এবং আমাদের দায়িত্ব। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এই আয়োজন।
লিয়াকত আলী লাকীর ভাবনা ও পরিকল্পনায় শিল্পী মিন্টু দে’র সাড়ে নয়শত ভাস্কর্য-এর ক্যানভাস নিয়ে এই প্রদর্শনী সাজানো হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একাডেমির ভেতরে উত্তর দিকে মাঠের এক অংশ ও বাগানের পাশে বেশ খানিকটা খালি জায়গা মিলে মোট এগার হাজার বর্গফুট স্থানে প্রদর্শনী ভ্যানু করা হয়েছে।
পুরো প্রদর্শনীতে গণহত্যার গোটা ত্রিশটি স্পট রয়েছে। বেশ কয়েকটি গাছ নিয়ে ক্যানভাসে যুদ্ধের সময়ে গ্রামের গণহত্যার চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। গ্রাম ও শহরে পাক বাহিনীর গণহত্যার নির্মম দৃশ্য এতে উঠে এসেছে। স্তরে স্তরে লাশ পড়ে আছে পাক বাহিনীর ক্যাম্পের উঁচু-নিচু ভূমিতে। বিভিন্ন বাড়ি ঘর থেকে বাঙালি নারী পুরুষকে ধরে রাস্তায় গুলি করে মারা হচ্ছে। মা’কে বেধে রেখে তার সামনেই শিশু সন্তানকে গুলি করা হচ্ছে। পিতাকে রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে ও গুলি করে মারা হচ্ছে। বাড়ির বারান্দায় পড়ে আছে গ্রামের নারী-পুরুষের লাশ। সেখান থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যুবতী মেয়েকে। নেয়া হচ্ছে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে। ক্যাম্পের সামনে অসংখ্য বাঙালিকে হাত-পা বেধে ফেলে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে তুলে নিয়ে লাইন ধরিয়ে গুলি করা হচ্ছে। শহরে রাস্তায় রিকশার ওপর লাশ,বধ্যভূমিতে অসংখ্য লাশ -এমন বর্বরোচিত গণহত্যারই সম্মিলন ঘটেছে এই প্রদর্শনীতে।
দুদিনব্যাপী এই প্রদর্শনী চলবে আগামীকাল ২৬ মার্চ পর্যন্ত। আগামীকাল সকাল থেকেই প্রদশর্নী সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। ছোট বড় সব বয়সের মানুষ প্রদর্শনী উপভোগ করছেন। প্রদর্শনী উপলক্ষে অনুষ্ঠান মঞ্চে পরে বিভিন্ন শিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার গান পরিবেশন করেন। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হবে আলোক প্রজ্জ্বলন।