শীতের আগমণে কাপড় বোনায় ব্যস্ত রাখাইন পরিবারগুলো

447

॥ একেএম খায়রুল বাশার বুলবুল ॥
বরগুনা, ১৮ নভেম্বর, ২০১৯ (বাসস) : বরগুনা ও পটুয়াখালী অঞ্চলের রাখাইন নারী তাঁতীদের উৎপাদিত চাদর, শার্ট পিস, ব্যাগ, শাড়ি, লুঙ্গী, গামছা প্রভৃতি বস্ত্রের কদর দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের সর্বত্রই রয়েছে। মিয়ানমার থেকে আমদানি করা বিভিন্ন রঙ বে-রঙয়ের সুতা দিয়ে হস্তচালিত তাঁতে তৈরী রাখাইনদের কারুকাজ খচিত বস্ত্রের চাহিদা সারা বছর খুব বেশি না থাকলেও শীত মওসুম ও ঈদে ব্যাপক চাহিদা দেখা যায়। শীত মৌসুমও শুরু হয়েছে। সকাল, বিকেল ও রাতের ঠান্ডা শীতের আগমণী বার্তা দিচ্ছে উপকূলের মানুষকে। শীতের আগমণে বরগুনার রাখাইন তাঁতীদেরও, ব্যস্ততা বাড়ছে কাপড় বোনায়।
মৌসুমী এ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড গত কয়েক বছর ধরে মোটামুটি সারা বছরই চালু থাকে বলে জানান রাখাইন নারী তাঁতিরা। তারা কারণ হিসেবে জানান, বরগুনার তালতলী উপজেলায় তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প, সোনাকাটা ইকোপার্ক, পাথরঘাটার হরিণঘাটা, লালদিয়ার চরে পর্যটনস্পট, পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়ায় পায়রা সমুদ্র বন্দর, ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, নৌ ঘাঁটি, দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন, কুয়াকাটার পর্যটন কেন্দ্রের জন্য চাহিদা বেড়ে যাওয়াকে।
১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা ও কলাপাড়া উপজেলার কালাচানপাড়া, গোড়াআমখোলাপাড়া, দিয়ারআমখোলাপাড়া, নয়াপাড়া, নাইউরী পাড়া, মংথয়পাড়া, থঞ্জুপাড়া, মিশ্রিপাড়া, লক্ষ্মীপাড়া, বৌলতলীপাড়া, পক্ষীয়াপাড়া, কেরানীপাড়া এবং বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার তালতলীপাড়া, ছাতনপাড়া, গোড়াঠাকুরপাড়া, আগাঠাকুরপাড়া, মনুসেপাড়া, অংকোজানপাড়া, তাতেপাড়া, লাউপাড়া, নামেসেপাড়া, কবিরাজপাড়া, সওদাগাড়পাড়া ও তালুকদারপাড়ায় রাখাইনরা স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করে। চল্লিশ দশকের শেষভাগে এ অঞ্চলগুলোতে ২৪২টি রাখাইন পাড়া বা পল্লী ছিল। প্রবীণ রাখাইনরা জানান, সে সময়ে বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলায় ৬০ হাজারের বেশী রাখাইন বসবাস করত। বর্তমানে রাখাইন জনসংখ্যা ১০ হাজারের নিচে নেমে এসেছে। বহু রাখাইন পাড়া বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এক সময়ে জায়গা জমি ধনদৌলতে খুবই স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ ছিল রাখাইনরা। তারা গড়ে তুলেছিলেন বড় বড় বৌদ্ধ বিহার (প্যাগোডা), শ্মশান (চে-শেই) ও শান বাঁধানো পুকুর। পালিত হতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানসহ বৈশাখী পূর্ণিমা, চৈত্র সংক্রান্তি বা সাংগ্রান, নববর্ষ উৎযাপনে জলকেলী উৎসবসহ নানা অনুষ্ঠান। শ্রমন, বিয়ে অনুষ্ঠান, শ্রাদ্ধ্য, বৌদ্ধ বিহারাধ্যক্ষের মৃত্যু পরবর্তী শ্রাদ্ধ্য আড়ম্বর পরিবেশে পালিত হতো। নানাবিধ সমস্যায় তারা আর্থ সামাজিক প্রতিযোগিতায় হো-চোট খেতে থাকে। এ অঞ্চল থেকে রাখাইন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমতে থাকে ক্রমান্বয়ে।
বরগুনার তালতলী পাড়া, ছাতন পাড়া, মনুখে পাড়া, আগাঠাকুর পাড়া, নিশানবাড়ীয়া ইউনিয়নের সওদাগর পাড়া, তালুকদার পাড়া ও সোনাকাটা ইউনিয়নের কবিরাজ পাড়া, নামিষে পাড়া, লাউ পাড়া ও অংকুজান পাড়াসহ রাখাইন পাড়াগুলোতে ১২ থেকে ১৪টি করে শতাধিক হস্তচালিত তাঁত রয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় একই পরিবারে দুই থেকে তিনটিও তাঁত রয়েছে। কলাপাড়া, কুয়াকাটা ও গলাচিপায় রয়েছে আরও দুই শতধিক তাঁত। এসব তাঁতে ৬ শ’র বেশী পেশাদার নারী তাঁতী কাপড় বুনন করে থাকেন।
বরগুনার তালতলী উপজেলার আগাঠাকুর পাড়ার উসিট মং জানান, এক সময়ে তাঁত বস্ত্রের উপরই নির্ভরশীল ছিল রাখাইন পরিবারগুলো। রাখাইন পরিবারের মধ্যে এমন প্রচলন ছিল যে, মেয়েরা হস্তচালিত তাঁত শিল্পের কাজ না জানলে তাদের বিয়ে হত না। রাখাইনদের তাঁতে প্রথম দিকে পরিবারের চাহিদা মেটাতে কাপড় বোনা হতো। পরে তারা বাণিজ্যিক পরিসরে এ কাজ শুরু করলে দেশব্যাপী তার কদর বাড়ে ঠিকই তবে যথার্থ পদ্ধতিতে বিপণন বা রপ্তানী না করতে পারায় এবং সীমিত সংখ্যক ক্রেতা ও চাহিদার কারণে এ শিল্প বেশীদূর যেতে পারেনি। বর্তমানে উপকূলে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ডে জনসমাগম বেড়েছে, বেড়েছে বিকিকিনিও। তাছাড়া যোগাযোগ মাধ্যমের উন্নতির সাথেসাথে তাদের পন্যের পসার ঘটবে বলে রাখাইনরা আলাপ কালে আশা প্রকাশ করেছেন।
রাখাইন কমিউনিটি নেত্রী ও স্কুল শিক্ষিকা অংতেন তালুকদার জানিয়েছেন, এ অঞ্চলে বসবাসরত রাখাইন সম্প্রদায়ের লোক সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছিল। কর্মসংস্থানের অভাবই ছিল তার প্রধান কারণ। বর্তমান সরকার আন্তরিকতায় এ অঞ্চলের প্রভূত উন্নয়ন হচ্ছে। আমরা আমাদের ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারব।