দুর্নীতি বিরোধী অভিযান ‘আইওয়াশ’ নয় : প্রধানমন্ত্রী

745

ঢাকা, ২৯ অক্টোবর, ২০১৯ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি বিরোধী অভিযানকে ‘আইওয়াশ’ বলে বিএনপি’র আশংকাকে উড়িয়ে দিয়ে এই অভিযানের শেষ অবদি দেখার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখানে ‘আইওয়াশ’ করতে যাব কিসের জন্যে। আমিতো কোন আপন পর দেখিনি। হ্যাঁ যারা অপরাধ জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা যেই হোক আমরা তাদেরকে ধরছি। সেটাকে তারা ‘আইওয়াশ’ বলে কেন? ঐসব আইওয়াশের বিষয়টা বিএনপিই ভাল জানে। দেশটাকে দুর্নীতিতে নিয়ে আসা, দুর্নীতিকে একেবারে নীতিতে পরিণত করা সেটাতো বিএনপি’রই করা।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ন্যাম সম্মেলন পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এদেশে মানি লন্ডারিং থেকে শুরু করে ঋণ খেলাপি কালচার, মেধাবী যুব সমাজের হাতে অস্ত্র ও অর্থ তুলে দিয়ে তাদেরকে বিপথে নিয়ে যাওয়া,সন্ত্রাসি বানানো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্ত্রের ঝনঝনানি-জিয়াউর রহমানই শুরু করে গেছে। এরপর যিনি আসলেন এরশাদ, তিনি আরো একধাপ উপরে। আর তারপরে খালেদা জিয়াতো দোকানই খুলে বসলো। একদিকে হাওয়া ভবন এবং অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উন্নয়ন উইং। উন্নয়ন মানে হলো ঘুষ খাওয়ার উইং। কিন্তু আমরা সরকারে আসার পরতো এ সমস্ত কিছু হয়নি।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘কাজেই এটাকে আইওয়াশ তারা বলে যাচ্ছে, ঠিক আছে দেখেন, অপেক্ষা করেন, ‘আইওয়াশ’ না কি তা দেখা যাবে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলীয় জোটের জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থাসহ গণমাধ্যমের সম্পাদক এবং সিনিয়র সাংবাদিকবৃন্দ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মূল যারা, আসল যারা দুর্নীতিবাজ, তারা দু’জনতো শাস্তি পেয়েই গেছে, খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে। এছাড়া তাদের (বিএনপি) আরো অনেকে দুর্নীতি, অগ্নিসন্ত্রাস, মানুষ খুনসহ বহু অপরাধে অপরাধী। পর্যায়ক্রমে সকলেই শাস্তি পাবে। সাজা তাদের পেতে হবে, এর জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে। তবে, তারাও শাস্তি পাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।’
রাজনীতিবিদ ছাড়াও অন্য পেশাজীবীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা সময়ই বলে দেবে, আসলে বেছে বেছে ক্রাইটেরিয়া ঠিক করেতো ধরা হচ্ছে না। যখন যেটা পাওয়া যাচ্ছে সেটাকেই ধরা হচ্ছে। ধরা পড়ার পরে না বোঝা যাচ্ছে কে কি। কাজেই অভিযান যখন চলছে তখন যখন যেটা বের হওয়ার তা বের হবে।’
তিনি বলেন, ‘অপরাধী অপরাধীই তার দলও নাই, কিছুই নাই। কাজেই যেই অপরাধ করুক অবশ্যই আমরা ধরবো, ধরা হবে।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাবার আদর্শ অনুসরণ করে ভয়-ডরবিহীন রাজনীতি করেন উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিভাবে সাহসের সাথে রাজনীতি করে এই বাংলাদেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। কাজেই ‘ভয়’ এই শব্দটা আমার নেই, ছোটবেলা থেকেই নেই। আর ভয় পাওয়ার লোক আমি নই। ভয় পেলে এই অভিযানে (দুর্নীতি বিরোধী) অভিযানে আমি নামতাম না।’ তিনি বলেন, ‘আমি যথন এখানে রয়েছি তখন অপরাধী কে, কোন দলের সেটা আমার কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। আর আমিতো আগেই বলেছি শুরু করলে তা ঘর থেকেই করতে হয়। নইলেতো বলবে যে, রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য আমরা করছি, তাতো না।’


সরকার প্রধান বিএনপি প্রসঙ্গে বলেন, তারাতো দুর্নীতির খনি। এদেশের দুর্নীতির যাত্রা শুরুইতো ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরুর এবং অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে। শেখ হাসিনা বলেন, অবৈধভাবে দখল করা ক্ষমতাকে নিষ্কন্টক করার জন্য বাংলাদেশের দুর্নীতির দুয়ার খুলে দিয়েছিল জিয়াউর রহমান। আর তার হাতে গড়া দল এই বিএনপি। আর সেখানে দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে হত্যা, খুন, মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে এবং দলের প্রধান দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে এখন কারাগারে। যাকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিল সেও দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে দেশান্তরী। তাদের মুখে এত বড় বড় কথা শোভা পায় না।

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে, ক্রিকেট খেলোয়াড়দের ধর্মঘট প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাদের যদি কোন দাবি-দাওয়া থাকতো তারা কিন্তু বিষয়টি পূর্বেই জানাতে পারতো।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ধর্মঘট করতে গেলে পূর্বে একটি দাবি-দাওয়া উত্থাপন করা হয় বা একটা সময় দেয়, নোটিশ দেয়, তারপরে করে। সেটা তারা করেনি।’
পরে ক্রিকেটারদের সঙ্গে ক্রিকেট বোর্ডের আলোচনায় বিষয়টির মিটমাট হয়ে গেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ক্যাসিনোর সঙ্গে ক্রিকেট বোর্ডকে জড়িত করার কোন কারণ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, হয়তো এখানকার কেউ এর সঙ্গে জড়িত ছিল। সেরকম সাংবাদিক মহলে খোঁজ করলেও পাওয়া যেতে পারে জানান তিনি।

তিনি এ প্রসঙ্গে কখন কিসে কে কোথায় ধরা পড়ে তার ঠিক নেই উল্লেখ করে সে ধরনের কোন ঘটনা ঘটলে কি করবেন বলে সাংবাদিকদের কাছে জানতে চান এবং বলেন, ‘যার কথা আপনারা বলছেন তাকে ধরা হয়েছে।’
এ সময় দেশে এ ধরনের ক্যাসিনো চলতে থাকলেও সংবাদপত্রে রিপোর্ট না আসার বিষয়ে ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি।
আইসিসির শাস্তির মুখে পড়তে যাওয়া ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বিষয়ে সরকারের খুব বেশিকিছু করণীয় আছে বলে মনে করেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিসিবি সব সময় সাকিবের সঙ্গে আছে। তাকে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে।’ তিনি বলেন, ‘ওর (সাকিব) যেটা উচিত ছিল, ওর সঙ্গে যখন যোগাযোগ করেছিল বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। আসলে ও একটা ভুল করেছে। আইসিসি যদি কোনো ব্যবস্থা নেয় আমাদের আসলে কিছু করার থাকে না। খুব বেশিকিছু যে করণীয় আছে সেটা কিন্তু নয়।’
এ সময় বাংলাদেশ-ভারত টেস্ট ম্যাচ দেখতে ভারতে যাওয়া সম্পর্কিত একটি সংবাদের বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রধানমন্ত্রী এটাকে কূটনেতিক কোন বিষয় নয় বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘সৌরভ গাঙ্গুলি একজন বাঙালি ছেলে। ও আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমি রাজি হয়ে গেলাম। একজন বাঙালি দাওয়াত দিয়েছে। আমি বলেছি আসবো। ও যে এখন বোর্ডে আছে তা নয়। ক্রিকেটার হিসাবেও আমার পছন্দের।’
প্রধানমন্ত্রী পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে এটাকে সাময়িক আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘ইতোমধ্যেই আমি খবর পেলাম প্রায় ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ আসছে। তাছাড়া ১০ হাজার টন কয়েকদিনের মধ্যেই চলে আসবে। কেউ যদি সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য পেঁয়াজ মজুদ করে থাকেন তাহলে এটা পচনশীল পণ্য হওয়ায় তারা নিজেরাও বিপাকে পড়ে যেতে পারেন বলেও সতর্ক করে দেন তিনি ।

অপর এক প্রশ্নের উত্তরে ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন না, কারণ তিনি নিজেও ওই ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। তবে, এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করায় এখন আর কোনো বক্তব্য থাকতে পারে না।


গত নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জনগণ যদি ভোট না দিত, আমাদের পক্ষে না থাকতো, তাহলে আমাদের সমর্থন থাকতো না। তাদের (বিএনপি) ভোটারবিহীন নির্বাচনের বিরুদ্ধে আমরা গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছিলাম। আমাদের জনসমর্থন ছিল।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘এবারের নির্বাচনে জনগণ, ব্যবসায়ীসহ সর্বস্তরের মানুষ আমাদের সমর্থন দিয়েছেন। শুধু আওয়ামী লীগের না, বিএনপির ব্যবসায়ীরাও আমাদের সমর্থন দিয়েছেন। কারণ আমরা সবাইকে কাজ করার সুযোগ করে দিতে পেরেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ দেশের উন্নয়ন করে। আমরা ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়। বাংলাদেশের সম্মান ফিরে এসেছে। ন্যাম সম্মেলনে যাওয়ার পর সবাই বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। সেখানকার প্রবাসীদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। তারা বলেছেন তারা ভালো আছেন। বাংলাদেশের উন্নয়নে তারা খুশি। তাই কারো কথায় কিছু যায়-আসে না।’
ধনী-গরিবের বৈষম্য হ্রাস সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা দেখা যায় যে দেশ যখন উন্নত হতে থাকে তখন কিছু লোকের কাছে বেশি অর্থ চলে আসে।
বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনীদের দেশে ফিরিয়ে আনা এবং পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের অগ্রগতি নিয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
নুসরাত হত্যায় দ্রুততম সময়ে বিচার অনুষ্ঠানের জন্য প্রধানমন্ত্রী সংবাদ পত্র, ইলেকট্রসিনক মিডিয়া সহ সকল গণমাধ্যমের ভ’মিকার প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, এই মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়ার মূলে ছিল নুসরাত নিজেই নিজের জবানবন্দী দিয়ে যেতে পেরেছিল। কারণ যে কোন হত্যা মামলার ক্ষেত্রে চাক্ষুস সাক্ষী থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে নুসরাতের নিজের জবানবন্দীটা ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্স। কারণ অনেক সময় আমাদের মামলার ক্ষেত্রে দেখা যায় স্বাক্ষীর অভাব থাকে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নুসরাতের বিষয়ে তার এলাকায় জনমতও সৃষ্টি হয়েছিল এবং আমি সাংবাদিকদেরও সাধুবাদ জানাই আপনারা একটা বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন। যে কারণে দ্রুত বিচার করা সম্ভব হয়েছে এবং এটা একটা দৃষ্টান্ত। ইনশাল্লাহ ভবিষ্যতে অন্যান্য মামলাগুলোর যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয় সে ব্যবস্থা আমরা নেব।


তিনি নুসরাত সম্পর্কে বলেন, ‘সে অত্যন্ত সাহসী মেয়ে। সে জীবন দিয়ে গেছে কিন্তু সাহসী একটা ভূমিকা রেখে গেছে এবং শেষ পর্যন্ত সে কিছুতেই নত হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে খারাপ লাগে একটি মেয়ে যে অন্তস্বত্তা সে কি করে খুনের মত একটি নৃশংস ঘটনায় জড়াতে,সহযোগিতা করতে পারে, গায়ে পেট্রল ঢালতে পারে। মানুষের মনুষ্যত্ব বোধ বলে কি কিছু নাই? এগুলোরতো শাস্তি হওয়া দরকার।’
সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।