প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সমস্যা সমাধানে সহযোগী মনোভাব প্রদর্শনের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বারোপ

763

ঢাকা, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবেশিদের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ জনগণের পারস্পরিক কল্যাণ এবং উন্নয়নের স্বার্থেই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে সমস্যা থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি প্রতিবেশির সঙ্গে সর্বক্ষেত্রে একটি সহযোগিতামূলক মনোভাব থাকলে পরে তা অনেক কিছু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেই সহজ হয়।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের করবী হলে ড. কালাম স্মৃতি উৎকর্ষ পুরস্কার-২০১৯ গ্রহণকালে প্রদত্ত ভাষণে একথা বলেন।
ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এবং বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এপিজে আব্দুল কালাম স্মরণে তামিল নাড়ু সরকার ২০১৫ সালে এ পুরস্কার প্রবর্তন করে।
ড. কালাম স্মৃতি ইন্টারন্যাশনাল’র প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রদূত টিপি শ্রীনিবাসন শেখ হাসিনার হাতে এই পুরস্কার তুলে দেন।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য তাঁর অসামান্য অবদান, জনকল্যাণ বিশেষত নারী ও শিশুদের কল্যাণে বিশেষ অবদান রাখা এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার জন্য শেখ হাসিনাকে এই স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী পুরস্কার গ্রহণের সময় দেশের জনগণের প্রতি কর্তব্য পালনে তাঁর দায়বদ্ধতার প্রতি প্রশংসার নিদর্শন হিসেবে এই পুরস্কার গ্রহণ করছেন বলে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘জনগণের প্রতি এই কর্তব্য পালনই আমার জীবনের মূলমন্ত্র, যেমনটি ছিল আমার পিতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। আমি এই পুরস্কার দেশের জনগণের উদ্দেশে উৎসর্গ করছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই পুরস্কার বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে ড. কালামের প্রত্যাশিত টেকসই আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বাস্তবায়নে উৎসাহিত করে চলেছে।
তিনি বলেন, দেশবাসীকে টেকসই উন্নয়ন অর্জনে আমি হয়তো সামান্য কিছু অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছি আর সেটা সম্ভব হয়েছে আমার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং দেশের জনগণের জন্য। যারা আমার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছে এবং এদেশের জনগণ আমাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে তাদের উন্নয়নের কাজ করতে সহযোগিতা করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাজেই সেদিক থেকে আমি মনেকরি এতে বাংলাদেশের জনগণেরই সব থেকে বড় অবদান।
তিনি বলেন, এই পুরস্কার আমাকে এবং আমার সরকারকে আগামী দিনগুলোতে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেমের সংরক্ষণ এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করে জনগণের বৃহত্তর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন অর্জনে কাজ করতে উৎসাহ যোগাবে।
অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনীতিবিদ, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী সহ ভারত ও বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত বিদেশি কূটনীতিক এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
ড. কালাম স্মৃতি আন্তর্জাতিক এডভাইসোরি কমিটির পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে কেরালার ঐতিহ্যবাহী শাড়ি এবং পুন্নাডা (এক ধরনের কাপড়) এবং সংস্থার লোগো উপহার দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সম্মানিত করা হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড.এ কে আব্দুল মোমেন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
ইতোপূর্বে মালদ্বীপ, ঘানা এবং মরিশাসের রাষ্ট্রপতিগণ এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
ড. কালাম স্মৃতি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারপার্সন দীনা দাস পুরস্কারের সাইটেশন পাঠ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পারস্পরিক আস্থা, প্রত্যয় ও শুভকামনার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গত এক দশকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
সরকার প্রধান বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রচলিত এবং অপ্রচলিত ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতিও সাধিত হয়েছে। আমি মনে করি বিশ্ববাসীর কাছে এটা আমরা একটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবনের স্বপ্ন ছিল দারিদ্র্য-ক্ষুধামুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করে গেছেন।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার ডাক দেন এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের বিজয় এনে দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই বিজয়ে আমাদের পাশে ছিল ভারত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারতের জনগণ।
তিনি বলেন, ভারতের প্রতিটি রাজনৈতিক দল সবসময়ই বাংলাদেশের বিষয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে এদেশের জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। যার প্রমাণ আমরা পেয়েছি আমাদের স্থলচুক্তি বাস্তবায়নের সময়। যখন ভারতের সংসদে এ সংক্রান্ত বিলটি সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়।
ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সে সময়ে উৎসব মুখর পরিবেশে ছিটমহল বিনিময়কে তিনি সারাবিশ্বের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা ’৭৫ পরবর্তী সময়ে দেশের ফিরতে না পারায় রিফিউজি হিসেবে ভারতে আশ্রয় গ্রহণের প্রসংগও উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজও জাতির পিতার স্বপ্ন ও রূপকল্পকে আমাদের উন্নয়নের আলোকবর্তিকা হিসেবে গণ্য করে তাঁরই প্রদর্শিত পথে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি এ সময় ভারতের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এবং রাষ্ট্রপতি ভারতরত্ন এপিজে আব্দুল কালাম এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মানবিক গুণাবলীর মধ্যকার বিভিন্ন সাদৃশ্য তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘উভয় নেতাই সাধারণ মানুষের সুপ্ত সম্ভাবনাসমূহকে উন্মোচিত করতে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন।’
প্রধানমন্ত্রী ভারত-বাংলাদেশের গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন, ‘বিদ্যমান সমস্যা দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার পাশাপাশি আমরা একসঙ্গে কাজও করতে পারি কারণ আমাদের সার্বক্ষণিক চিন্তাই জনগণকে নিয়ে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণ অর্থাৎ শুধু আমাদের দেশ নয়, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর জনগণও এর সুফলটা পেতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই সবসময় আমরা আমাদের পদক্ষেপ নেই। সেজন্য একটি বন্ধুত্বসুলভ প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর সবসময় আমরা জোর দিয়েছি এবং আমরা তা করতে সক্ষম হয়েছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই অনেকগুলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৯তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।
তাঁর সরকারের সাফল্য তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের মাথাপিছু আয় ২০০৬ সালে ৫৪৩ মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯ সালে ১৯০৯ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। গত এক দশকে আমাদের জিডিপি’র বার্ষিক গড় বৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশের উপর, যা ২০১৮-২০১৯ সালে হয়েছে ৮ দশমিক ১ শতাংশ।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে তাঁর সরকার বর্তমানে ২১ শতাংশে নামিয়ে এনেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে এবং এখন পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একটি দেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য- এমন অভিমত ব্যক্ত করে সরকার প্রধান বলেন, তাঁর সরকার ইতোমধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় গুরুত্ব প্রদানের পাশাপাশি সারাদেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে ব্রডব্রান্ড ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়া সহ নিজস্ব উদ্যোগে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে তাঁর সরকার তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত প্রযুক্তির প্রসার ঘটিয়ে বাংলাদেশকে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সামিল করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকারের আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে এসব উন্নয়ন কর্মকান্ডগুলো যেন টেকসই হয়। কেননা বাংলাদেশ বহুবছর নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে চলতে পারেনি।
এ সময় ’৭৫ এ জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একের পর এক যে আঘাত এসেছে তা দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে, দেশ পিছিয়ে গেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর কখনও যাতে না ঘটে এবং আমাদের উন্নযনের গতিধারাটা যেন অব্যাহত থাকে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি উন্নয়নের সাথে সাথে শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে মানুষের চিন্তা-চেতনায় যত বেমি স্বচ্ছতা আনা যাবে ততই মানুষ নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে। তাহলে তাদের ভাগ্য নিয়ে আর কেউ ছিনিমিনি খেলতে পারবে না।’