জনগণ কোন দুর্নীতিবাজের সঙ্গে নেই : প্রধানমন্ত্রী

817

পটিয়া, চট্টগ্রাম, ২১ মার্চ, ২০১৮ (বাসস) : খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতের রায় না মেনে বিএনপি’র তথাকথিত আন্দোলনের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জনগণ কোন দুর্নীতিবাজের সঙ্গে নেই।
তিনি বলেন, ‘তারা আইন মানবে না, কানুন মানবে না-এমনই তাদের চরিত্র। তারা জনগণের সম্পদ, এতিমের টাকা লুটে খাবে। আর এজন্য আদালত শাস্তি দিল কেন? এজন্য হুমকি, ধমকি আন্দোলন।’
জনগণ কোন সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবাজের সঙ্গে নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ হবে শান্তির দেশ।
শেখ হাসিনা আজ বিকেলে পটিয়া সরকারি কলেজ এবং আদর্শ স্কুল মাঠে চট্টগ্রাম মহানগর এবং চট্টগ্রাম জেলা উত্তর ও দক্ষিণ আয়োজিত বিশাল জনসভায় প্রদত্ত ভাষণে একথা বলেন।
খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলা এবং কারাবাস সম্পর্কে তিনি বলেন, এতিমখানার জন্য বিদেশ থেকে টাকা এসেছে- আপনারা চিন্তা করে দেখেন পবিত্র কোরাআন শরীফে লেখা আছে এতিমের হক কেড়ে নিওনা। আর তারা কোরআন শরীফের নির্দেশ অমান্য করেছে। এতিমের টাকার একটি টাকাও এতিমখানায় যায় নাই। সব নিজেরা আত্মস্যাৎ করেছে।
এই মামলা আওয়ামী লীগ সরকার নয়, বরং খালেদা জিয়ার পছন্দের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ফখরুদ্দিন এবং সেনাপ্রধান মইনউদ্দিন দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই মামলা রুজু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন আর রায় দিয়েছে আদালত।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় খালেদা জিয়া, দুই ছেলে তারেক ও আরাফাত রহমান এবং খালেদা জিয়া সরকারের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান কালো টাকা সাদা করেছেন বলে অভিযোগ করে এই অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, সিঙ্গাপুর এবং আমেরিকার আদালতে খালেদা জিয়ার দুই ছেলের অর্থ পাচার ধরা পড়ার পর তাঁর সরকার সে টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
জনসভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা আওয়ামী লীগ দক্ষিণের সভপতি মুসলেম উদ্দিন আহমেদ।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি, চট্টগ্রামের মেয়র আজম নাসির উদ্দিন, স্থানীয় সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরী, উপ প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, উপ দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়–য়া, সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহজাদা মহিউদ্দিন, প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি আবু সুফিয়ান বক্তৃতা করেন।

বাবা, মা, ভাই ও স্বজনসহ সব হারানো শোকব্যথা বুকে নিয়েও তাঁর একটাই কাজ উল্লেখ করে জাতির পিতার কন্যা বলেন, আমার একটাই চাওয়া-পাওয়া। আর তা হচ্ছে এদেশের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন। প্রতিটি মানুষ অন্ন পাবে, রোগে শোকে চিকিৎসা পাবে, মাথা গোঁজার ঠাই পাবে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত প্রতিটি মানুষ উন্নত জীবন পাবে এবং সুন্দরভাবে বাঁচবে।
তিনি সকলের দোয়া ও আশির্বাদ চেয়ে তাঁর রাজনীতি জনকল্যাণের জন্য উল্লেখ করে বলেন, আমি আপনাদের কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চাই। আপনরা নৌকা মার্কায় ভোট দিন, আমরা আপনাদের উন্নয়ন দিতে পারবো।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যদি নৌকায় ভোট পেয়ে আগামীতে ক্ষমতায় আসতে পারি তাহলে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা থাকবে। আমরা এলএনজি আমদানী করছি, এলপিজি করছি, শিল্প কলকারখানা করছি এবং দেশের যে উন্নতি করছি তার সবই আপনাদের স্বার্থে। কাজেই একমাত্র নৌকা মার্কায় ভোট দিলে দেশের উন্নতি হবে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর অন্যান্য প্রাক নির্বাচনী জনসভার মতো জনগণের কাছে হাত তুলে ওয়াদা চাইলে বিশাল জনতা চিৎকার করে এবং দুই হাত তুলে নৌকায় ভোট প্রদানের ওয়াদা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বিএনপি’র আন্দোলনের নামে মানুষ হত্যার সমালোচনা করে বলেন, এই চট্টগ্রামে স্কুল শিশুর ওপর বোমা মেরে তার দুই চোখ নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। অন্তঃস্বত্তা মহিলাকে পেট্রোল বোমা মেরে হত্যা করা হয়েছে। ২৭ জন পুলিশকে হত্যা করা হয়েছে। বিজিবিকে হত্যা করা হয়েছে। মা, বোন থেকে শুরু করে কোলের শিশু পর্যন্ত কেউ রেহাই পায়নি।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার নির্দেশে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে তারা (বিএনপি) মানুষ হত্যা করেছে। চলন্ত ট্রেন ও বাসে আগুন দিয়েছে। ড্রাইভার-হেলপার ও সাধারণ মানুষ পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। ৫শ’ মানুষকে হত্যা এবং তিন হাজারের বেশি মানুষকে আহত করেছে তারা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যাদের মধ্যে এতটুকু মনুষত্ব অবশিষ্ট থাকে তারা একাজ কোনদিন করতে পারে না, যে কাজ ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে বিএনপি আন্দোলনের নামে করেছে। তারা আমাদের ছাত্রলীগ, যুব লীগ, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদেরও একের পর এক হত্যা করেছে। এমনকি শিক্ষকরা পর্যন্ত তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।
শেখ হাসিনা বলেন, তারা বাংলাদেশকে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ ও বাংলা ভাইয়ের দেশ বানিয়ে দেশের ভাবমুর্তি নষ্ট করেছে। এই চট্টগ্রামে পাচার করা ১০ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়েছে। যে পাচারের সঙ্গে জড়িত খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান। আজকে যার সাজা হয়েছে।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধের সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ এবং মাদক বিরোধী আন্দোলনে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের অন্তর্ভুক্তিও কামনা করেন।
তিনি ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের ধর্মের মৌলিক শিক্ষা এবং মর্মবাণী মানুষের কাছে তুলে ধরার আহবান জানিয়ে বলেন, নিরীহ মানুষ খুন করলে কেউ বেহেশতে যেতে পারে না, তাকে দোজকে যেতে হবে, এটা সকলকে বোঝাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ এবং মাদক থেকে আপনজনকে দূরে রাখতে আপনাদের ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশের মানুষ অনেক কষ্ট ভোগ করেছে। জাতির পিতাকে হত্যার পর দীর্ঘদিন দেশের কোন উন্নয়ন হয়নি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার বিএনপি’র ’৯৬ সালে রেখে যাওয়া ১৬শ’ মেগাওয়াট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট করেছে। দেশে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হচ্ছে। পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে। যেখানে বিদ্যুতের গ্রীড লাইন নেই সেখানে সোলার প্যানেল বসানো হচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপি শাসনামলে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ১ মেগাওয়াটও না বাড়িয়ে উল্টো কমিয়ে ফেলা হয়।
তিনি বলেন, ২০০১ সালে তাঁর সরকার দেশকে ৪ হাজার ৩শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম রেখে গেলেও তা তারা (বিএনপি-জামায়াত) পরবর্তী ৫ বছরে ৩২শ’ মেগাওয়াটে নামিয়ে আনে।
ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রীর মুচলেকা দিয়েই খালেদা জিয়ার সরকার ক্ষমতায় এসেছিল উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, তিনি ভারতের কাছে গ্যাস রপ্তানী করতে রাজি ছিলেন না। তাঁর কথা ছিল দেশের জন্য ৫০ বছরের জন্য রিজার্ভ রেখে তার পরেই গ্যাস রপ্তানীর কথা ভাবা হবে। কারণ এটা দেশের জনগণের সম্পদ।
সে সময় বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরই শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস দেখা দেয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছাত্রলীগের ৮ জন কর্মীকে একসঙ্গে হত্যা করা হয়। এ ভাবে বহু মানুষ তারা হত্যা করেছে। অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীকে হত্যা করেছে। তারা শুধু আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমর্থক নয়, নিজের দলের লোককেও হত্যা করেছে। জামাল উদ্দিন তাদেরই একজন। অপহরণের ছয় মাস পর তার কঙ্কাল উদ্ধার হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জাতির পিতা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন।
আওয়ামী লীগ দেশের উন্নতি ও শান্তি চায় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশকে উন্নত করতে হলে শান্তি প্রয়োজন এবং সেই লক্ষ্য নিয়েই আওয়ামী লীগ কাজ করে যাচ্ছে।
যুবকদের জন্য কর্ম সংস্থান ব্যাংক এবং সেখান থেকে বিনা জামানতে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদান, কর্মসংস্থানের জন্য বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করে দেয়া, ১শ’ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলাসহ প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের পরিসংখ্যান তুলে ধরেন।
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করে দেয়াসহ চট্টগ্রাম বিভাগের উন্নয়নে তাঁর সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, এই দেশ জাতির পিতা স্বাধীন করে গেছেন। আজ আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। বিশ্বে আমরা মাথাউঁচু করে চলছি। আর কেউ মিথ্যা অপবাদ দিতে পারবে না।
প্রধানমন্ত্রী পদ্মাসেতু নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগকে চ্যালেঞ্জ জানানো এবং তা প্রমাণিত হওয়ায় দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন।
চট্টগ্রামবাসীকে নৌকায় ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, প্রয়োজনে বুকের রক্ত দিয়ে হলেও আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সুন্দর জীবন দিবো। সেই ওয়াদা করছি।
তিনি বলেন, আমি আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। কারণ সব সময় আপনাদের সহযোগিতা পেয়েছি। আমি যখন দেশে এসেছি তখন আপনাদের মধ্যে খুঁজে পেয়েছি হারানো বাবা-মা ও ভাইয়ের স্নেহ। তাই আপনাদের জন্য আমি যে কোনো ত্যাগ শিকারে প্রস্তুত।