বিভিন্ন নদ-নদীর পানি ৭৩ পয়েন্টে বৃদ্ধি ও ১৮ পয়েন্টে হ্রাস

216

ঢাকা, ১৩ জুলাই, ২০১৯ (বাসস) : অতি ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে সুরমা ছাড়া দেশের সকল প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
আজ সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘন্টায় বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ৯৩টি পানি সমতল স্টেশনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, ধলাই, খোয়াই, সোমেশ্বরী, কংস, ধরলা, তিস্তা, ঘাগট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, সাঙ্গু ও মাতামুহুরী এই ১৪টি নদীর পানি ২৫টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন নদ-নদীর পানি ৭৩টি পয়েন্টে বৃদ্ধি ও ১৮টি পয়েণ্টে হ্রাস পেয়েছে। শনিবার ১৫টি নদীর ২৩টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম ও মেঘালয় প্রদেশসমূহের বিস্তৃত এলাকায় আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টায় মাঝারী থেকে ভারী এবং কোথাও কোথাও অতিভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সংলগ্ন ভারতের বিহার এবং নেপালে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
নদ-নদীর পরিস্থিতি সম্পর্কে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীরণ কেন্দ্রের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আজ জানানো হয়েছে, পানি পরিস্থিতি ১টি পয়েন্টে অপরিবর্তিত রয়েছে এবং ১টি পয়েন্টের কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগামী ৭২ ঘন্টায় ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, পদ্মা ও যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে এবং আগামী ২৪ ঘন্টায় যমুনা নদী সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।
আগামী ২৪ ঘন্টায় সিলেট ও রংপুর বিভাগের সুরমা, কুশিয়ারা, কংস, সোমেশ্বরী, ধরলাসহ প্রধান নদীসমূহের পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। এ ছাড়া আগামী ২৪ ঘন্টায় নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
গতকাল সকাল ৯টা থেকে গত ২৪ ঘন্টায় পঞ্চগড় স্টেশন এলাকায় ২০০ মিলিমিটার, ডালিয়ায় ১৭৭ মিলিমিটার, রাঙ্গামাটিতে ১২৫ মিলিমিটার, টাঙ্গাইলে ১২২ মিলিমিটার, মহেশখোলায় ১৯০ মিলিমিটার, নরসিংদীতে ২০৮ মিলিমিটার, ঢাকায় ১০২ মিলিমিটার, শ্রীমঙ্গলে ২৫০ মিলিমিটার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৪৫ মিলিমিটার এবং কুমিল্লায় ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এদিকে বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। কন্ট্রোল রুমের ফোন নম্বর ৯৫১৫৫৫১। এই কন্ট্রোল রুম সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
বন্যা পূনর্বাসনে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বন্যা উপদ্রত এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো হয়েছে এবং বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিংয়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে জেলা পর্যায়ে মেডিকেল টিম এবং জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে ত্রাণ কার্যক্রম তদারকি করা হচ্ছে।
বাসস’র কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। জেলার ৯টি উপজেলার চরাঞ্চলের তিন শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৫২টি ইউনিয়নের প্রায় ২ লাখ মানুষ।
জেলার ৭৭টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে ৩ হাজার ৮০০ জন আশ্রয় নিয়েছেন।
বন্যার পাশাপাশি নদী ভাঙনে এ পর্যন্ত গৃহহীন হয়েছে ১ হাজার ৩১টি পরিবার। ভেঙে গেছে দুটি স্কুল। স্কুল দ’ুটি হলো, নাগেশ^রী উপজেলার শংকর মাধবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নাগেশ^রীর এলাহীরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এদিকে সদরের হলোখানা ইউনিয়নের সারডোব, বাংটুর ঘাট, উলিপুরের চর বজরা ও রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের গাবুরহেলান গ্রামে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হুমকির মুখে রয়েছে। এই এলাকাগুলোতে বাঁধ মেরামতেবালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আরিফুল ইসলাম জানান, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলো ২৪ ঘন্টা নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান প্রধান জানান, ক্ষতির পরিমাণ নিরুপন ও কৃষকদের পরামর্শ দেয়ার জন্য কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারিদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
স্কুলগৃহে, মাঠে ও চলাচলের রাস্তায় পানি ওঠায় কুড়িগ্রামে ২৮৫ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এসব স্কুলের অনেকগুলোই চার-পাঁচ ফুট পানির নিচে তলিয়ে আছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো: শহিদুল ইসলাম জানান, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে শিক্ষকদের উপস্থিত থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসাধারণকে বন্যা মোকাবেলায় সহায়তার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সুনামগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, জেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হয়েছে। রোববার দুপুর পর্যন্ত শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জেলার ৮ উপজেলায়ই বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪ হাজারে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ফরিদুল হক জানিয়েছেন, সরকারি উদ্যোগে ১০ টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হলেও দুর্গতরা আশ্রয় কেন্দ্রে আসছেন না। তবে দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এই পর্যন্ত বন্যার্তদের সহায়তার জন্য ৫০০ টন চাল, সাড়ে ১০ লাখ টাকা এবং ৫ হাজার ২৩৫ প্যাকেট শুকনো খাবার এসে পৌঁছেছে।
সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেন, বন্যায় সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি রয়েছে। ত্রাণসামগ্রী যা প্রয়োজন তা দেয়া হবে।
সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট শামীমা শাহরিয়ার আজ বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছেন। তাহিরপুর উপজেলার পৈন্ডুপ, জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী ইউনিয়নের আছানপুর, হরিনাকান্দি, মাহমুদপুর, মদনাকান্দি ও জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের মমিনপুর, কামিনীপুর, ভুইয়ার হাটি ও হিন্দু কালীপুর গ্রামে পাচঁ শতাধিক পরিবারের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন। ত্রাণ সামগ্রীর মধ্যে ছিল চাল, ডাল, তেল, লবন, চিনি, চিড়া, নুডুলস, শিশুদের জ্বরের ঔষধ প্যারাসিটামল সিরাপ, খাবার স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নে বন্যা দুর্গত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ৬২০ পরিবারের মধ্যে শুকনো খাবার প্যাকেট ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো.শরিফুল ইসলাম।
হবিগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, জেলায় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। হাওরেও বৃদ্ধি পাচ্ছে পানি। কুশিয়ার নদীর পানি বৃদ্ধিতে নবীগঞ্জ, বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জের অন্তত ৫০ গ্রামের মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছেন।
হবিগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক ও রাজস্ব) তারেক মোহাম্মদ জাকারিয়া জানান, নবীগঞ্জ উপজেলার দীগলবাক ও ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ১০ টন চাল বরাদ্ধ করা হয়েছে। খোয়াই নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সবাইকে সতর্ক থাকার আহবান জানানো হয়েছে।
বাসস’র চট্টগ্রাম অফিস জানায়, খাগড়াছড়ি জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করেছে। আজ সকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হলেও ভারী বর্ষণ হয়নি। খাগড়াছড়ি জেলা সদর ও পানছড়ি উপজেলার নি¤œাঞ্চল থেকে পানি সরে যাওয়ায় লোকজন বসতবাড়িতে ফিরে গেছেন।
খাগড়াছড়ির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. হাবিব উল্লাহ জানান, খাগড়াছড়ির সামগ্রিক বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে। যে কোন ধরণের দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে জেলা প্রশাসন। পানিবন্দি মানুষের সাহায্যার্থে রান্না করা খাবারের পাশাপাশি ৫০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি জেলার বন্যাদুর্গতদের জন্য ৮০ টন চাল বরাদ্দ করেছে স্থানীয় জেলা প্রশাসন। চলছে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম। জেলা সদর ও উপজেলা পর্যায়ে ১৭টি আশ্রয় কেন্দ্রের মধ্যে ৮টিতে লোকজন আছেন। ফেনী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় রামগড়ে শনিবার নতুন একটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ওই কেন্দ্রে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।