প্রস্তাবিত বাজেটে চ্যালেঞ্জ আছে, তবে অতীতের মতো বাস্তবায়নও সম্ভব : সরকারি দল

449

সংসদ ভবন, ১৯ জুন, ২০১৮ (বাসস) : প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারি দলের সদস্যরা বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে চ্যালেঞ্জ আছে, তবে অতীতের মতো তা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
তারা বলেন, বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বিএনপি-জামায়াতের ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্র। তারা দেশকে পেছনের দিকে নিয়ে যেতে চায়। এদের ব্যাপারে সকলকে সচেতন থাকতে হবে।
দলের সদস্যরা আরো বলেন, সরকার তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ৯৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে। পদ্মা সেতুসহ বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে আজ বিকেল ৩টা ১৪ মিনিটে অধিবেশনের শুরুতে মন্ত্রীদের জন্য প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা-উত্তর টেবিলে উপস্থাপন শেষে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা শুরু হয়।
গত ৭ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন।
২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট আলোচনার তৃতীয় দিনে আজ কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং, সরকারি দলের মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীরোত্তম, উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ, মোহাম্মদ ফারুক খান, এ কে এম এ আউয়াল (সাইদুর রহমান), শামসুল হক টুকু, মোতাহার হোসেন, বেগম সানজিদা খানম, জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, মুহম্মাদ আলতাফ আলী ও বেগম খোরশেদ আরা হক অংশ নেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জনগণের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটেছে। বিগত ৯ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার কি কি অগ্রগতি সাধন করেছে বাজেটে তা বিবৃত হয়েছে।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনার গতিশীল ও দূর-দৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বে দেশ এখন বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা অত্যন্ত সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে গড় প্রবৃদ্ধি বিগত ৮/৯ বছর আগে তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না, এখন ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, ৮/৯ বছর আগে সরকারি বিনিয়োগ ছিল ৪ দশমিক ৩ শতাংশ, এখন ৮ দশমিক ৩ শতাংশ, মাথাপিছু আয় ছিল ৭৬৯ ডলার, আর এখন ১ হাজার ৭৫২ ডলারে উন্নীত হয়েছে, তখন মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ দশমিক ৩, এখন মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে। সাধারণত আয় বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়ে কিন্ত শেখ হাসিনার সরকারের দক্ষ অর্থমন্ত্রীর পরিচালনায় এই মূল্যস্ফীতিকে কমিয়ে এনেছেন। রাজস্বের জিডিপি ৮/৯ বছর আগে ছিল ৯ দশমিক ২ শতাংশ ছিল, এখন তা ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। বাজেটের আকার ছিল তখন ৮৯ হাজার কোটি টাকা, এখন ৪ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। বার্ষিক রপ্তানি ছিল ১৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার, বর্তমানে ৩৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। বার্ষিক আমদানী ছিল ২২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, এখন ৪৭ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভ ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ছিল তখন, বর্তমানে ৩২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। দরিদ্র জনগোষ্ঠী ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল, এখন তা কমে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। হতদরিদ্র ছিল ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ, এখন ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স ২০০৯ সালে ছিল দশমিক ৫৩৫, ২০১৭ সালে তা হয় দশমিক ৫৭৯। শিশু মৃত্যুর হার ছিল হাজারে ৩৯ জন, এখন ২৮ জন। ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৬৩ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। পাশাপাশি ৫১ লাখ মানুষের বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে।
মতিয়া চৌধুরী বলেন, মাদক আমাদের যুব শক্তিকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। জঙ্গিবাদ, মাদক এবং সন্ত্রাস এরা একে-অপরের পরিপূরক। এদের টার্গেট হলো যুব সমাজ। জঙ্গি ও সন্ত্রাসীরা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পেরে যুবকদের ধ্বংস করার কাজে নেমেছে। মাদকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছেন। মাদকের বিরুদ্ধে তিনি সাঁড়াশি অভিযানের নির্দেশ দিয়েছেন। কেউ কেউ মাদকের বিরুদ্ধে এই অভিযানকে সমর্থন না করে এর বিরোধিতা করছে। এদের উদ্দেশ্য ভালো নয়। যুব সম্প্রদায়কে মাদকের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে, অন্যথায় দেশের অগ্রগতি ব্যাহত হবে।
তিনি বলেন, ১০ জানুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘আজ থেকে এই মাঠে রেস খেলা বন্ধ, বাংলাদেশে জুয়া বন্ধ, মদ নিষিদ্ধ’। আর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ‘একদিকে বললেন বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, অন্যদিকে ৩৬০টি মদের লাইসেন্স একই দিনে ইস্যু করলেন। হাউজি খেলা শুরু করলেন।’ জিয়াউর রহমানের একটি উক্তি ছিল ‘মানি ইজ নো প্রোবলেম’। আর এর পরিণতিতে দেশের যুব সমাজ মাদকের ছোবলে তছনছ হয়ে গেছে।
মতিয়া চৌধুরী বলেন, সরকার ১০ বছরের অগ্রগতিকে ধরে রাখতে চায়, সে লক্ষ্যেই ২০১৮-১৯ সালের বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ৪ দশমিক ৯ শতাংশ, এটা সহনীয় সীমার মধ্যেই রয়েছে এবং তা তিনি উন্নয়নের তাগিদেই করেছেন, এটা বরাবরের ঘটনা। এবার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব।
তিনি বলেন, সরকারের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে সমালোচকরা বলেন, বাজেট নাকি বাস্তবায়ন হয় না। বাজেটই যদি বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলো কিভাবে? এডিপির আকারই বা বৃদ্ধি পেলো কিভাবে?
কৃষিমন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনার সরকার শুধু উন্নয়নেই বিশ্বাস করে না, উন্নয়নের ফসল যাতে সবাই ভোগ করতে পারে, তা তিনি নিশ্চিত করতে চান। এজন্যে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এই খাতে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২৭৩ দশমিক ২ কোটি টাকা, এখন ৬৪ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। উপকার ভোগী পরিবার ছিল ১৩ শতাংশ, এখন ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ।
সঞ্চয়পত্রে সুদের হার না কমানোর কারণে তিনি অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর ঘোষণা আসলে মধ্যবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। কারণ এই সুদ দিয়েই তারা জীবন ধারণ করে। অর্থমন্ত্রী সঞ্চয়পত্রের লাভের ওপর হাত দেবেন না বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং বলেন, বাংলাদেশকে একটি উন্নত সমৃদ্ধ ও প্রযুক্তি নির্ভর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উন্নয়নে প্রস্তাবিত বাজেটে আরো অধিক পরিমানে বাড়ানোর দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার তিন পার্বত্য জেলার উন্নয়নে বিভিন্ন উৎসাহব্যঞ্জক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তির ৫২টি ধারার মধ্যে ৪৮টির অধিকাংশ ধারা ও উপ-ধারা বাস্তবায়ন করেছে। বাকিগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে। বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সরকার পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সরকার তিন পার্বত্য জেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
সরকারি দলের মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীরোত্তম শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানান। স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা এবং তাদের সন্তানদের সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সহায়তার আওতায় আনতে হবে এবং স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা মহিলাদের মেয়ে সন্তানদের জন্য আলাদা এতিমখানা চালু করার দাবি জানান।
সরকারি দলের সদস্য উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ চা শ্রমিকদের জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। তিনি ধলাই নদীর বাঁধ নির্মাণ এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সংস্কারের দাবি জানান।
বিরোধী দলের সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে অব্যবস্থাপনা দূর করতে না পারলে বাজেটের সুফল জনগণ পাবে না। তিনি কমপক্ষে ৩ লাখ টাকার উপরে যারা আয় করে তাদের আয়করের আওতায় আনার প্রস্তাব করেন।