’৭৫-এর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হতে পিছিয়ে দিয়েছে : প্রধানমন্ত্রী

692

ঢাকা, ১৮ মার্চ ২০১৮ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বলেছেন, বাংলাদেশ স্বাধীনতার দশ বছরের মধ্যেই একটি উন্নত দেশে পরিণত হতে পারতো যদি ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনা জাতির জীবনে না আসতো। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তিন বছরের মধ্যেই যখন আমরা স্বল্পোন্নত দেশ হয়েছিলাম। আর ৫টি বছর হাতে পেলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারতো। এটি আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, স্বাধীনতার ১০ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ উন্নত হতে পারতো। কিন্তু স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ৪৭ বছর লেগে গেছে উন্নয়নশীল দেশ হতে। আর যাতে বাংলাদেশ না এগুতে পারে সেজন্যেই ছিল ষড়যন্ত্র।
তিনি এই ষড়যন্ত্রের বিষয়টি ভালই উপলব্ধি করতে পারেন উল্লেখ করে বলেন, ’৭৫ সালের পর ছয় বছর তাঁকে শরণার্থী হিসেবে বিদেশে থাকতে হয়েছিল। আর যখন ’৮১ সালে দেশে ফিরে রাজনীতি শুরু করেন-প্রতি পদেই বাধার সম্মুখীন হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিকেলে জাতির পিতার ৮৯তম জন্মদিন এবং জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় যারা এক সময় আমাদের করুণার চোখে দেখতো, আর একটা ঋণ নিতে গেলে একটা প্রকল্প করতে গেলে হাজার রকম শর্ত জুড়ে দিতো, আর দুর্নীতি না করলেও দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে প্রকল্পের টাকা বন্ধ করে দিত (যেমন পদ্মা সেতু), তারা আর এটা করতে পারবে না। সেই সাহস আর পাবে না।
তিনি বলেন, আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশ ঋণ পেতে আর সমস্যা হবে না, হয়তো একটু সুদ বেশি দিতে হবে। তাতে কিছু আসে যায় না। ঐটুক আমরা দিতে পারি। মানুষের জন্য আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করলে যে দেশের উন্নযন করা যায় এটি তাঁর সরকার প্রমাণ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলাম বলেই আজকে উন্নয়নের ছোঁয়াটা মানুষ পাচ্ছে।
যদি আমরা ক্ষমতায় না আসতে পারতাম, তাহলে ২০০১ সালের বিএনপি-জামায়াতের মত আমাদের উন্নয়ন অর্জনগুলো আবার নষ্ট করে দিতো,বলেন প্রধানমন্ত্রী।
জাতীয় সংসদের উপনেতা এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, আব্দুল মতিন খসরু এবং এম এ মান্নান, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, শিল্পী হাশেম খান এবং সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন আলোচনা সভায় বক্তৃতা করেন।
দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন।

শেখ হাসিনা এ সময় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, তাঁদের সমর্থন পেয়েছি সব সময়।
আওয়মী লীগের নেতৃস্থানীয়দের অবস্থান কোন কোন সময় টালমাটাল হলেও আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা কখনও আমার থেকে দূরে যায়নি, বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমি বাবা, মা ভাই সব হারিয়ে সেই স্বজনহারা বেদনা নিয়ে এসেছি। কিন্তু আমি ভালবাসা পেয়েছি বাংলাদেশের মানুষের। গ্রামে গ্রামে যখন গিয়েছি ঐ গ্রামের মহিলারা ছুটে এসেছে, বুকে জড়িয়ে নিয়েছে। মাথায় হাত বুলিয়ে গায়ে কপালে চুমু খেয়েছে। আর একটা কথাই বলেছে, মা তোমার বাপতো জীবনটা দিয়ে গেল আমাদের জন্য। আবার তুমিও মাঠে নেমেছো।
এই কথাগুলোই তাঁকে প্রেরণা ও শক্তি দিয়েছে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, এসব মানুষদের মাঝেই তো আমি আমার হারানো বাবা-মা’র স্নেহ- ভালোবাসা পেয়েছি। আর এসব মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনেই আমার বাবা সারাজীবন রাজনীতি করেছেন। তাই তাঁদের জন্য কিছু করাকে আমি কতর্ব্য বলে মনে করেছি। কোন আশা-আকাঙ্খা বা রাজনৈতিক উচ্চাভিলাসের জন্য আমার রাজনীতি নয়, কোন পদের জন্য নয়,মনে করেছি এটা আমার কর্তব্য।
দেশের আর্থসমাজিক উন্নয়নের প্রসংগ তুলে প্রধামন্ত্রী বলেন, আজকে বাংলাদেশে কুঁড়ে ঘর নাই বললেই চলে। বঙ্গবন্ধুর চালু করে যাওয়া গুচ্ছগ্রামের পদাংক অনুসরণ করেই তাঁর সরকার ভ’মিহীনদের মঝে খাস জমি বিতরণ সহ আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ভিটেমাটিহীনকে ঘর-বাড়ি করে দিচ্ছে। ঘরে ফেরা কর্মসূচির মাধ্যমে বস্তিবাসীকে নিজগ্রামে পূনর্বাসন করা হচ্ছে। গৃহায়ণ তহবিল করে ১ শতাংশ সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে পূনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বয়স্কা ভাতা, স্বামী পরিত্যক্তা ভাতা,প্রতিবন্ধী ও দু:স্থ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, কৃষকদের ভর্তুকি, বন্ধ কারখানা চালু সহ প্রধানমন্ত্রী এ সময় তাঁর সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের বিভিন্ন কর্মসূচির উল্লেখ করেন।
দেশের এই অগ্রযাত্রায় তাঁর সরকারের বেসরকারী খাতকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার ভ’মিকা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আর যাই হোক জানি না, আমার দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হোক সেটাই আমি চাই। সেই সাথে আমাদের যুব সমাজের জন্য কর্মসংস্থান ব্যাংক করে দিলাম। যেখান থেকে বিনা জামানতে তার দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিয়ে নিজেই একটা কিছু করতে পারবে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় কৃষি ব্যাংক থেকে বর্গা চাষীদের বিনা জামানতে ঋণ প্রদানের প্রসংগ উল্লেখ করে বলেন, বিএনপি এই ব্যাংকের অনেক শাখা বন্ধ করে দেওয়ায় আমি বলেছিলাম শাখা লাগবে না, হাটের দিনে কৃষকের দোড়গোড়ায় ব্যাংক চলে যাবে। হাটের থেকেই ঋণ প্রদান করবে।
’৯৮ সালের দেশব্যাপী বন্যার পরেই এই কর্মসূচি চালু করায় ফসল উৎপাদন বেড়ে যায়, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
হিজড়া, বেদে, চা শ্রমিকসহ সকল অবহেলিত জনগণের উন্নয়নে তাঁর সরকারের দৃষ্টি রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমাজের প্রতিটি জায়গায় তাঁর সরকার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
তাঁর সরকার পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনা এবং ১০ বছর মেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা গ্রহণ করায় দেশের পরিকল্পিত উন্নয়ন হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি কোন সময় পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনা নিতো না। তারা এডহক ভিত্তিতে দুই বছর, তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নিত। যার কোন ফল দেশ পায়নি। কিন্তু তারা পেয়েছে নিজেদের ভাগ্য গড়েছে। তাঁর সরকার সরকারে এসেই লক্ষ্য নির্ধালন করেছে ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী পালন এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী- এই সময়েই দেশটাকে একটি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন সাধারণ মানুষের কথা বলেছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এজন্য তাকে জীবনভর নানা বঞ্চনা সইতে হয়েছে। বারবার মামলায় গ্রেফতার হয়ে বেশির ভাগ জেলে থাকতে হয়েছে তাকে। বারবার মানুষের কথা বলতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে জেলে যেতে হয়েছে জাতির পিতাকে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, কারাগারে বসেও বঙ্গবন্ধু মানুষের জন্য আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। ’৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে, তখনই বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই তিনি এই জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্ধুব্ধ করেন ।
তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বঞ্চনার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের এখানে কাগজ তৈরি হতো, পাট উৎপাদন হতো কিন্তু এখানকার মানুষকে বেশি দামে কিনতে হয়েছে এসব থেকে উৎপাদিত পণ্য। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে তার ছিল খুবই অল্প দাম।
সরকার প্রধান বলেন, বঙ্গবন্ধু দিনের পর দিন বঞ্চনার এই কথাগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরতেন। এখানকার অনেক নেতাকে দেখেছি মন্ত্রিত্ব পাওয়ার লোভে পড়ে যেতেন কিন্তু বঙ্গবন্ধু কোনো লোভে পড়েননি। বাবা-মা তাকে আদর করে ডাকতেন খোকা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দাদীর কাছে শুনেছি, বঙ্গবন্ধুর নানা তাকে কোলে নিয়ে বলেছিলেন, তোর ছেলের নাম শেখ মুজিবুর রহমান। দেখবি, একদিন জগৎ জোড়া নাম হবে তার।’ তার কথাই সত্যি হয়েছে। শুধু নিজের নাম নয়, বাঙালিকে বিশ্বসভায় পরিচিত তিনিই করে দিয়েছেন।
১৯৬৫ সালের ভারত-পকিস্তান যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই যুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্ব বাংলা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু এটা নিয়ে কথা বলেছেন। এর মধ্যে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। এর কদিন পর তিনি ছয় দফা ঘোষণা করেন। যা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ।
তিনি বলেন, বাঙালিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে এবং দলকে সংগঠিত করতে জাতির পিতা জেলায় জেলায় যেতেন। যে জেলায় যেতেন সে জেলায়-ই তার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হতো, সেখানেই গ্রেফতার। এই মুক্তি, এই গ্রেফতার। এভাবে তাকে মামলা ও গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এরপর ঊনসত্তরে তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দেওয়া হয়। যথন ছয় মাস পর্যন্ত পরিবারের লোকজন জানতে পারেননি বঙ্গবন্ধু আদৌও জীবিত কি না, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন,সে সময় ছয় দফার থেকে সরে এসে ৮ দফা দাবি তোলার প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বললেও তাঁরা কখনও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা থেকে সরে আসেন নি এবং জামিনে মুক্তি নিয়ে পাকিস্তানে আলোচনার জন্য যেতে বললেও বঙ্গবন্ধু জীবনের মায়া ত্যাগ করেও তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
জাতির পিতা শেখ মুজিব আমাদের স্বাধীনতা দেওয়ার জন্যই জন্মেছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি যদি না জন্মাতেন তাহলে আমরা বাঙালি জাতি হিসেবে আত্মপরিচয় পেতাম কি না, একট স্বাধীন দেশ পেতাম কি না সেটাই একটা বড়ো প্রশ্ন। তাঁর ২৩ বছরের সংগ্রাম এবং জাতির পিতার নেতৃত্বে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে আমাদের এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে।