বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করছে জেন্ডার বাজেট

662

॥ সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন ॥
ঢাকা, জুন ২৯, ২০১৯ (বাসস) : সরকারি নীতি-কৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়ন নারীর ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করেছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে জেন্ডার বাজেট চালুর পর থেকে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর যে ক্ষমতায়ন হয়েছে ,সরকারের সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ তা সম্ভব হয়েছে ।
জেন্ডার বাজেট রিপোর্ট ২০১৯-২০ এ উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারি নীতি-কৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জেন্ডার সংবেদনশীলতা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করায় জেন্ডার গ্যাপ সূচকের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল গত ১৩ই জুন জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করার সময় এই রিপোর্ট উপস্থাপন করেন।
নারীর ক্ষমতায়নে বিভিন্ন নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণের পাশাপাশি নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গৃহীত নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের আর্থিক সম্পদের ব্যবস্থাপনার গতিবিধি লক্ষ্য করা ও অন্যান্য অংশীদারদের রাষ্টীয় দায়বদ্ধতা বজায় রাখার জন্য এই জেন্ডার বাজেট চালু করা হয়। প্রতিবছর এই বাজেটের উপর প্রতিবেদন প্রণয়ন করে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়।
জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন ২০১৯-২০ এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে নারী উন্নয়নে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ৩০.৮২ শতাংশ এবং জিডিপি’র ৫.৫৬ শতাংশ। জেন্ডার বাজেট চালুর বছর, ২০০৯-১০ অর্থবছরে নারী উন্নয়নে মোট বরাদ্দ ছিলো ২৭ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত নারী উন্নয়ন বরাদ্দ বার্ষিক গড়ে প্রায় ২২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রথম বারের মত নারী উন্নয়নে ৪টি মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহিত নীতি, কৌশল, কার্যক্রম, নারী উন্নয়নে প্রধান কর্মকৃতি নির্দেশকসমূহের অর্জন এবং বাজেটের কত শতাংশ নারী উন্নয়নে ব্যয় হবে তা উল্লেখ করে জাতীয় সংসদে জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। বর্তমান অর্থবছরে ৪৩টি মন্ত্রণালয়/বিভাগের নারী উন্নয়ন ও বাজেট বরাদ্দের পর্যালোচনা করে জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
নারী উন্নয়নে দেশের অগ্রগতি বিষয়ক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৬ সালে বাংলাদেশে পুরুষের তুলনায় নারীর অগ্রগতি ছিলো ৬২.৭ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে ৭২.১ শতাংশে উন্নীত হয়। বিশ্ব গড় মানের উপর ভিত্তি করে এ অগ্রগতি নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিকে ২০০৬ সালে ১১৫ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ৯১তম। ২০১৮ সালে ১৪৯ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ৪৮তম। গত চার বছর যাবৎ একটানা বাংলাদেশ জেন্ডার গ্যাপ সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে অবস্থান করছে।
গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকার অবস্থান ১০০তম, নেপাল ১০৫তম, ভারত ১০৮তম, মালদ্বীপ ১১৩তম, ভূটান ১২২তম ও পাকিস্তান ১৪৮তম।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৬ সালে গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ সূচক চালুর পর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নারী-পুরুষের সমতার মাত্রা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ৪২.৩ শতাংশ থেকে ৪৪.১ শতাংশে, শিক্ষা ক্ষেত্রে ৮৬.৮ শতাংশ থেকে ৯৫.০ শতাংশে, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ৯৫.০ শতাংশ থেকে ৯৬.৯ শতাংশে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ২৬.৭ শতাংশ থেকে ৫২.৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
বিশ্ব পরিমন্ডলে নারী-পুরুষ বৈষম্য এখনো উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে বিদ্যমান আছে উল্লেখ করে জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপি সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ৭৭.১ শতাংশ এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ৪১.৯ শতাংশ নারী-পুরুষ বৈষম্য রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি খুবই সন্তোষজনক।
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ২০১৮ সালে ১৪৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫ম এবং বিদ্যমান বৈষম্যের মাত্রা ৪৭শতাংশ, যা বিশ্ব গড় মানের তুলনায় অনেক কম বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
নারীর উন্নয়নে জেন্ডার বাজেটের গুরুত্ব বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে স্টেপস টুওয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট-এর নির্বাহী পরিচালক ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞ রঞ্জন কর্মকার বলেন, নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জেন্ডার বাজেট একটা বড় ধরনের ভূমিকা পালন করছে।
সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি ও জেন্ডার বাজেটের ফলে বর্তমানে নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরী হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন রঞ্জন কর্মকার। তিনি বলেন, এর আগে নারীরা ক্ষুদ্র ঋণের জন্য বেসরকারি সংস্থার উপর নির্ভরশীল ছিলো। কিন্তু বর্তমানে তারা সরকারের কাছ থেকে অল্পসুদে বেশী ঋণ নেওয়ার সুবিধা পাচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে নারীরা মাঝারি উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পাচ্ছে।
স্বাস্থ্যখাতে জেন্ডার বাজেটের অবদান উল্লেখ করে কর্মকার বলেন, নারী উন্নয়নকে বিশেষ বিবেচনায় রেখে নীতি ও বাজেট প্রণয়নের ফলে শিশু মৃত্যু ও মাতৃ মৃত্যু হার অনেক কমে এসেছে। নারী-বান্ধব শিক্ষা বাজেট নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
ক্রমবর্ধমান জেন্ডার বাজেটকে সময়োপযোগী উল্লেখ করে তিনি বলেন সরকার নারীর চাহদিাগুলোকে বিবেচনায় রেখে জেন্ডার বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি করছে। কারণ নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও তাদের অবদানকে স্বীকৃতি না দিয়ে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া সম্ভব না।
তিনি বলেন, নারীর যথাযথ ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে নারীর প্রতি রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে এবং নারী-বান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্যোগী হতে হবে। অন্যথায় নারীরা বাইরে বের হলে তাঁদের প্রতি সহিংসতা বাড়বে। নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়লে, তাদের পক্ষে যে অবদান রাখার কথা, তা তারা রাখতে পারবে না। এটি সার্বিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করবে।