বাসস ইউনিসেফ ফিচার-৩ : সড়ক পরিবহন আইন : গণ পরিবহনের নারী যাত্রীদের জন্য স্বস্তি

390

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-৩
গণ পরিবহন-নারী
সড়ক পরিবহন আইন : গণ পরিবহনের নারী যাত্রীদের জন্য স্বস্তি
ঢাকা, ১৭ জুন, ২০১৮ (বাসস) : এক কোটির বেশি মানুষের বাস এই রাজধানী ঢাকা শহরে। জীবনের তাগিদে ঘড়ির কাটার সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলতে হয় নগরবাসীকে। কিন্তু চাইলেও সব সময় সেটা সম্ভব হয়না পরিবহণের স্বল্পতার কারণে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে পুরুষের পাশাপশি নারীরাও আজ চাকুরি করছে। যে কারণে পুরুষের পাশাপাশি একজন নারীকেও সেই সকাল বেলায়ই বের হতে হয় কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু রাস্তায় গণ পরিবহণের স্বল্পতা এবং আইনের কারণে অনেক সময়ই এক জন নারীকে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। কেননা অধিকাংশেরই বাহন গণ পরিবহন। একজন নারী গণ পরিবহণে কিভাবে নানাবিধ হয়রানির শিকার হন সেটাই জানাচ্ছেন মারিয়া ফারহানারা। ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল পৌনে নয়টার ঘরে। বাসা থেকে বেরিয়েছেন আটটায়। সোয়া আটটায় এসে পৌছেছেন মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্ত্বর বাস স্ট্যান্ডে। কিন্তু আধা ঘণ্টার চেষ্টায়ও গন্তব্যের বাসে উঠতে ব্যর্থ। আর বেশী দেরী করলে অফিসের হাজিরা খাতায় লাল কালির আঁচড় পড়বে। তাই শেষতক রিকশায় যাত্রা। যাবেন ফার্মগেইট। যার কথা বলছিলাম তার নাম মারিয়া। চাকুরি করেন ফার্মগেইট এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। থাকেন মিরপুর সেনপাড়া পর্বতা এলাকায়। প্রতিদিন এরকম ঝক্কি ঝামেলার মধ্যেই অফিসে যাতায়াত করতে হয় তাকে। অধিকাংশ সময়ই রিকশা। ফারহানা জানান, পুরুষদের সাথে প্রতিযোগিতা করে বাসে উঠা অনেক দূরহ একটি কাজ। তাছাড়া বাসে উঠতে গিয়ে অনেক সময় আপত্তিকর স্পর্শের শিকার হতে হয়। তাই নিরূপায় হয়ে রিকশায় যাই।
এদিকে মৃদু গতিতে চলছে বাস। দরজার দিকে ছুটছেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক। দরজায় দাড়িয়ে থাকা হেলপার কাউকে টেনে কাউকে পিঠে হাত দিয়ে তুলছেন বাসে। এটি ধানমন্ডি সিটি কলেজের সামনে দুপুর বেলার চিত্র। সেখানে তৌফিকা ইসলাম নামে একজন অভিভাবক জানালেন, আমরা স্বল্প আয়ের মানুষ। সামর্থ্য থাকলে সন্তানদের গাড়ি দিয়ে স্কুলে পাঠাতাম। কিন্তু বাসই আমাদের ভরসা। আপনিই দেখেন এখানে বাসগুলো ঠিক মত থামায় না, হেলপারগুলোও সুযোগ বুঝে অশোভন আচরণ করে।
উপরের দুটি ঘটনা শুধু এই দুই নারীর ক্ষেত্রেই নয়, গণপরিবহণ ব্যবহারকারী নারীদের নিত্যসঙ্গী এই বিড়ম্বনা। অনেক নারী যাত্রীর অভিযোগ বাসে উঠার সময় যেমন বিড়ম্বনার শিকার হন তেমনি বাসের ভেতরে যাত্রীদের দ্বারাও অনেক সময় হয়রানির শিকার হন তারা। আবার নারী আসনে পুরুষ বসে থাকলে তাদের উঠাতে গিয়েও নানা ধরণের বাজে মন্তব্যের শিকার হতে হয় তাদের।
তবে এবার এই চিত্র পাল্টানোর আশা করছেন নারীরা। কারণ এখন থেকে তাদের নির্ধারিত আসনের আইনী সুরক্ষা পাবেন তারা। নারী আসনে পুরুষ বসলে বা বসতে দিলে জেল জরিমানার আইনে ইতোমধ্যেই সায় দিয়েছে মন্ত্রিসভা। ২০১৭ সালের ২৭ মার্চ মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন দেয়া সড়ক পরিবহণ আইন ২০১৭ এর খসড়ায় বলা হয়েছে, কোন পুরুষ যদি বাসে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্ধারিত আসনে বসেন বা বসতে দেয়া হয় তবে তাকে এক মাসের জেল অথবা ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হবে।
নতুন এই আইনকে স্বাগত জানিয়েছেন নারীর অধিকার আদায়ে কাজ করার বিভিন্ন সংস্থা, মানবাধিকারকর্মী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। নতুন এই আইনের বিষয়ে প্রচারণা, মানুষকে সচেতন করা এবং মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে কিছু অভিযান চালিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া গেলে গণপরিবহণ আরও নারীবান্ধব হবে বলে মনে করেন, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক এডভোকেট সালমা আলী। তিনি বলেন, প্রচলিত অনেক আইন রয়েছে যা নারীর সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট। গণপরিবহণে হেল্প লাইনগুলোর নাম্বার টানিয়ে দেয়া উচিত। আর নারীদেরও প্রতিবাদ করতে হবে, কারণ জরিপে আমরা দেখেছি হয়রানির ঘটনায় অর্ধেক নারীই কোন প্রতিবাদ করেন না।
এ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, কিছুদিন আগে আমাদের একটি গবেষণায় দেখেছি ঢাকা শহরে গণপরিবহণে যাতায়ত করেন মাত্র ২১ শতাংশ নারী। সিংহভাগই (৪৭%) চলাচল করেন রিকশায়, আর ১৯ শতাংশ নারীকেই ভরসা করতে হয় দুই পা’য়ের উপর অর্থাৎ হেঁটে যাতায়ত করেন। এর কারণটা কী? গবেষণায় আমরা যেটি পেয়েছে তা হলো, গণপরিবহণে হয়রানির ভয়ে নারীরা এই বিকল্প পরিবহণ ব্যবহার করছেন। সিএনজি অটোরিক্সায় যাতায়ত করছেন ৭ শতাংশ নারী। কাজেই গণপরিবহণকে আমরা নারীবান্ধব করতে পারলে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ আরো বাড়বে।
কিন্তু শুধু আসন নিশ্চিত করলেই নারীবান্ধব গণপরিবহণ পুরোপুরি নিশ্চিত হবে তা বলা যাচ্ছে না। সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং এ্যাকশন এইড বাংলাদেশের জরিপে দেখা গেছে নারীরা বিভিন্ন স্থানে যে হয়রানির শিকার হন বিশেষ করে যৌন হয়রানি তার ২৩ শতাংশই হয় গণপরিবহণে এবং এর ৫৬ শতাংশই ঘটে থাকে বাসে বা লেগুনায় উঠা নামার সময়।টিকেট কাউন্টারে ২২ এবং চালক ও কন্ডাক্টর দ্বারা ১৮ শতাংশ নারী হয়রানির শিকার হন। আর গণপরিবহণের ভেতরে এই হয়রানির মাত্রা ৪ শতাংশ। আবার গণপরিবহণে যাতায়তকারী অর্ধেক নারীই ভুগেন যৌন হয়রানির আতংকে। যাত্রী পরিবহণ কল্যাণ সমিতির হিসেবে ২০১৫ সালে বাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৪৩ জন নারী।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, আমরা নারীদের আসন নিশ্চিত করার বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি। সরকার এ বিষয়ে আইনও করেছে। মিনিবাসে ৬ টি এবং বড় বাসে নয়টি সিটি নারীর জন্য সংরক্ষিত থাকবে। দ্বিতল বাসে এ সংখ্যা ১৩টি। চালক, কন্ডাক্টরদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পেলে আমরা সাথে সাথে ব্যবস্থা নিচ্ছি। যাত্রীদের সাথে অশোভন আচরণ এবং তার দন্ড সম্পর্কেও আমরা লিখিত নির্দেশনা দেবো। আমরা সচেতনতামূলক আরও কর্মশালার আয়োজন করবো।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত তারা দেড় লাখ চালককে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন যেখানে যাত্রীদের প্রতি বিশেষ করে নারীদের প্রতি আচরণের বিষয়টিও তাদের প্রশিক্ষণে আলোচনা করা হয় বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান।
আইন কিংবা অবকাঠামোর উন্নয়নের পাশাপাশি মানসিক পরিবর্তনের জায়গাটিতেও নজর দেয়া জরুরী বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানী ড. মোহিত কামাল। পুরুষদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে, নারীর প্রতি সম্মানের বিষয়টিতে তাদের খেয়াল রাখতে হবে এবং সেটি যদি পরিবার থেকে গড়ে ওঠে তাহলে গণপরিবহণে পুরুষদের আচরণে পরিবর্তন আসবে বলেও মনে করেন এই মনোবিজ্ঞানী।
আর নারীদের জন্য আলাদা বাসের সংখ্যা আরও বাড়বে বলেও জানিয়েছে সরকারি পরিবহণ সংস্থা বিআরটিসি। ঢাকা শহরে তাদের বহরে বর্তমান ১৭টি বাসের সঙ্গে আরও নতুন বাস যোগ হবে আগামী এক বছরে।
সুতরাং আইন যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো গেলে গণ পরিবহনে নারীরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণ করতে সক্ষম হবেন এমনটাই আশা সকলের।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/সুঘো/স্বব/০৯৩০/আহো/-ওজি