জাপান সবসময়ই আমার হৃদয়ের কাছাকাছি : শেখ হাসিনা

675

ঢাকা, ২৮ মে, ২০১৯ (বাসস) : পূর্ব এশিয়ার দেশ জাপান সফরকে সামনে রেখে বাল্যকাল থেকেই দেশটি নিয়ে আগ্রহ থাকার কথা ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকেই তাঁর এই আগ্রহের সৃষ্টি।
তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা জাপানকে নিয়ে আমার বেশ আগ্রহ ছিল। আমি জাপানি চিত্রকলা, ক্যালেন্ডার, স্ট্যাম্প, পুতুল প্রভৃতি সংগ্রহ করতাম।’
সোমবার জাপানের জাতীয় দৈনিক জাপান টাইমসে প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রীর এক প্রবন্ধ থেকে একথা জানা যায়।
তিনি বলেন, ‘আমার বাবার কাছ থেকেই এটা আমি পেয়েছি। বাংলাদেশকেও একদিন আরেকটি জাপান হিসেবে গড়ে তোলার তাঁর আকাঙ্খার কথা আমার জানা ছিল। জাপানে আশা এবং সম্প্রীতির এক নতুন যুগের যে সূচনা হয়েছে। এই নতুন সময় আমাদের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসুক, সম্পর্ককে আরো গভীর করে তুলুক এবং আমাদের শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ এবং উন্নত পৃথিবী গড়ে তোলায় সহায়ক হোক’।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ এং জাপানের মধ্যে সবসময়ই পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস এবং সহযোগিতার ভিত্তিতে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে।
১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে প্রথম দিকে স্বীকৃতি প্রদানকারী দেশগুলোর অন্যতম দেশ হিসেবে জাপান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং জাপানী স্কুল শিশুরা তাঁদের টিফিনের অর্থ বাঁচিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল।
তিনি বলেন, আমাদের জাতীয় পতাকার মধ্যেও সাদৃশ্য রয়েছে। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায়ই বলতেন জাপানের পতাকা তাঁকে সূর্যোদয়ের দেশ হিসেবে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং আমাদের পতাকায় সবুজের বুকে লাল সূর্য লাখো শহীদের আত্মত্যাগেরই প্রতিচ্ছবি।
প্রধানমন্ত্রী প্রবন্ধে লেখেন, বঙ্গবন্ধু সবসময় আমাদেরকে জাপানের কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে শিল্পোৎপানের পথে যাওয়ার বিবর্তনের প্রতি লক্ষ্য করতে, বিশেষ করে খামার ব্যবস্থপনার বিষয়ে উৎসাহ জোগাতেন। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক জাপান সফরের সময়ই আমাদের দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের শক্ত ভীত গড়ে ওঠে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশের অসামান্য আর্থসামাজিক উন্নয়ন বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে বিস্ময় জাগিয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের জনগণ কেন্দ্রিক উন্নয়ন মডেল যার ভিত্তি ‘কেউ পেছনে থাকবে না’- এটাই আমাদের এই চমকপ্রদ লক্ষ্য অর্জনের চাবিকাঠি। বাংলাদেশ গত এক দশকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের ওপর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছে, যা এ বছর নাগাদ ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে উন্নীত হওয়ার আশা করা হচ্ছে এবং অচিরেই প্রবৃদ্ধিকে দুই অংকের ঘরে নিয়ে যাওয়াই লক্ষ্য।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রূপকল্প-২০২১ এর সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ ২০৪১ সাল নাগাদ একটি উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে চায়।
তিনি বলেন, আমাদের তরুণ জনশক্তিকে দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করার মাধ্যমে বিশ্বের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে পারাও আমাদের এই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
তাঁর সরকার জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা এবং মানুষের উন্নত জীবন মান নিশ্চিত করতে ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সারাদেশে একশ’ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়েছি। যার মধ্যে একটি অঞ্চল হবে কেবল জাপানী বিনিয়োগকারীদের জন্য।
এ সময় বিরোধী দলে থাকতে ১৯৯২ সালে জাপানের একটি সম্মেলনে যোগদান করতে গিয়ে সে সময় জাপানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমার প্রথম জাপান সফরের সময়ই পদ্মা এবং রূপসা সেতু নির্মাণে সহযোগিতার বিষয়ে জাপান অঙ্গীকার করে। রূপসা সেতুটি জাপানেরই তৈরী করে দেয়া এবং পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাবই সমীক্ষাটিও তাঁরাই সম্পন্ন করে। সে সময় জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ককে শক্তিশালী করার জন্য সংসদীয় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কমিটিও গঠন করা হয়েছিল।’
১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ জাপানের কাছ থেকে ১১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার উন্নয়ন সহযোগিতা গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আর এটিই জাপানকে আমাদের সর্ববৃহৎ দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।’
তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে জাপানের সহায়তা বেশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষ করে কর্ণফুলী সার কারখানা, প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁও নির্মাণ এবং বিভিন্ন বড় শহরগুলোতে পানি সরবরাহ সৃষ্টিতে।
অন্যদিকে, আমাদের জাপান প্রবাসী নাগরিকরাও সেদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছে।
বাংলাদেশে জাপানের উদ্যোক্তাদের ব্যবসা স্থাপনের উদ্যোগ এবং উৎসাহ আমাদেরকে আশাবাদী করে তুলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমানে জাপানের ২৮০টি ফার্ম বাংলাদেশে কাজ করছে, যা গত ১০ বছরের মধ্যে ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাপানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, জাপানের বিভিন্ন কোম্পানীগুলোর বাংলাদেশে ব্যবসা করতে আসার বিষয়ে আস্থা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি বলেন, জাপান-বাংলাদেশ পাবলিক-প্রাইভেট সংলাপ দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ সম্পর্ককে শক্তিশালীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দুই দেশের সরকার টু সরকার সহযোগিতায় পিপিপির মাধ্যমে ৬টি প্রকল্প রয়েছে।
ব্যবসায়িক শর্ত শিথিল করা দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পূর্ব শর্ত উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এই কারণেই একই স্থান থেকে বিনিয়োগকারীদের সবরকম স্ুিবধাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতেই দেশে ২০১৮ সালে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সব চেয়ে বেশি নমনীয় এবং সহায়ক বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ তাঁর সকল ক্ষেত্রেই বিদেশী এবং ব্যক্তিগত বিনিয়োগকে স্বাগত জানায় এবং বিনিয়োগের পরিমাণ নিয়েও কোন বিধি-নিষেধ নেই।
তিনি বলেন, ‘বিদেশী বিনিয়োগকারিরা বিপুল পরিমাণ শুল্ক রেয়াত এবং আর্থিক প্রণোদনার সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। পৃথিবীর ৩২টি দেশের সঙ্গে আমাদেও দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি রয়েছে এবং জাপান সহ ২৮টি দেশের সঙ্গে দ্বৈত কর মওকুফের চুক্তি রয়েছে।’
২০২২ সাল বাংলাদেশ এবং জাপান কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ তম বর্ষপূর্তি উদযাপন করবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি আস্থাশীল যে, শান্তি এবং উন্নয়নে আমাদের উভয়ের মূল্যবোধ এবং অঙ্গীকার আমাদের জনগণের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। আর আমাদের দুই দেশের জাতীয় পতাকার আমাদের সেই লক্ষ্য অর্জনের পথেই সুদৃঢ় বন্ধনে বেঁধে রাখে।