ঘূর্ণিঝড় ফণী : ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে জনজীবন

591

ঢাকা, ৪ মে ২০১৯ (বাসস) : ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাসহ বিভিন্ন জেলায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে সবশেষ বাসস-এর সংবাদদাতারা জানিয়েছেন, বিভিন্ন জেলায় জনজীবন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। বাসস-এর বিভিন্ন জেলা সংবাদদাতাদের এ সংক্রান্ত পাঠানো প্রতিবেদন।
চট্টগ্রাম: ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে শনিবার সকাল থেকে চট্টগ্রামে ঝড়ো হাওয়াসহ গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। বিকেলেও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জেলার কয়েকটি জায়গায় বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। নগরীর বিভিন্ন সড়কে গাছপালা, বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়েছে। কয়েকটি সড়কে যানবাহন চলাচলেও ব্যাঘাত ঘটছে। তবে ফায়ার সার্ভিস ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) উদ্ধার টিম বিকালের মধ্যেই এসব সরিয়ে ফেলেছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী বলেন, আসকার দিঘীরপাড়, চন্দনপুরা, কোতোয়ালী থানার সামনে এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় কয়েকটি গাছ ভেঙে পড়েছে। এসব এলাকায় সিটি করপোরেশনের টিম গিয়ে দ্রুত গাছ গুলো সরিয়ে ফেলেছে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরীতে কয়েকটি জায়গায় গাছপালা ভেঙ্গে পড়েছে। দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্পের নির্মাণাধীন বাঁধ ভেঙ্গে আকমল আলী রোড এলাকায় জোয়ারের পানি ঢুকে পড়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে জেলার আনোয়ারা উপজেলার গহিরা, সীতাকু-ের ছলিমপুর ও সন্ধীপের সারিকাইতসহ কয়েকটি এলাকার নিম্নাঞ্চল জোয়ারের পানিতে প্লাবিত এবং মিরসরাই উপজেলায় তিনটি কাঁচাঘর ধ্বসে পড়েছে। গ্রামাঞ্চলেও কয়েকটি এলাকা থেকে গাছ উপড়ে পড়ার তথ্য পেয়েছি। তবে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।’
চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারি পরিচালক জসিমউদ্দিন জানিয়েছেন, নগরীর চন্দনপুরা ফায়ার সার্ভিসের সামনে একটি গাছ উপড়ে পড়ে সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের টিম গাছটি সরিয়ে ফেলেছে।
এদিকে বৃষ্টি শুরুর পর পাহাড় থেকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরতদের সরাতে কাজ করছে জেলা প্রশাসনের একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কামাল হোসেন জানিয়েছেন, বাটালি পাহাড়ে বসবাসকারী একশ’ পরিবারের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
বরগুনা: ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে বরগুনা উপকূলে প্রবল ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে শনিবার সকাল সাড়ে নয়টা পর্যন্ত এক নাগাড়ে চলে। শনিবার সকাল ১০টার দিকে আকাশ তুলনামূলকভাবে পরিস্কার হয়ে বৃষ্টিপাত থেমে রয়েছে। তবে ঝড়ো হাওয়া অব্যহত রয়েছে। নদীপথে সকল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। সকাল দশটার পরে সড়কপথে গাড়ি চলাচল শুরু হয়েছে।
এদিকে, জেলার ৩৩৫টি ঘুর্নিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় গ্রহনকারিদের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরন করা হয়েছে বলে উপজেলা প্রশাসন, পৌরসভা ও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
বরগুনার জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ জানিয়েছেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমান প্রাথমিকভাবে নিরূপন করা শুরু হয়েছে। প্রশাসন সব ধরনের পরিস্থিতি মোকবেলায় সচেষ্ট রয়েছে।
লক্ষ্মীপুর: ঘূর্ণিঝড় ফণী’র আঘাতে লক্ষ্মীপুর জেলায় প্রায় তিন শতাধিক বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। উপকূলীয় রামগতি ও কমলনগরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় কাঁচা, টিনসেড ও আধাপাকা ঘর ভেঙে এবং চাল উড়ে গিয়ে আরো ১৫ জন আহত হয়েছেন। শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার পর থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ঝড়ো হাওয়া ও ভারি বৃষ্টিপাত হয়।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে জেলার রামগতিতে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে অন্তত ১২০টি কাঁচা, আধাপাকা ও টিনসেডের বসতঘর। আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরো ১৮১টি বসতঘর। তাছাড়া বোরো ধান, সয়াবিন, বাদাম, মুগডাল, মরিচ ও সবজিসহ ৩ হাজার একর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে সহায়তা হিসেবে ২ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ২ লাখ টাকা বিতরণ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। এদিকে কমলনগর উপজেলার মাতাব্বরহাট এলাকায় ফণীর প্রভাবে মেঘনার তীব্র ঢেউয়ে নদী তীর রক্ষা বাঁধে আবারও ধস নেমেছে।
জেলা প্রশাসক অঞ্জন চন্দ্র পাল বাসসকে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে রামগতিসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় তিন শতাধিক বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আরো অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৩ হাজার একর ফসলি জমি।’
তিনি জানান, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ত্রাণ ও নগদ টাকা বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এছাড়াও পরবর্তীতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার গুলোকে আরো সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
এর আগে, ঘূর্ণিঝড় ফণী মোকাবেলায় জেলার উপকূলীয় এলাকার মানুষের জন্য ৩৭৫টি মেট্রিক টন চাল, ২ হাজার পাঁচশ’ বস্তা শুকনো খাবার ও নগদ ৫ লাখ টাকা বরাদ্ধ দেয় জেলা প্রশাসন।
সাতক্ষীরা: জেলায় শুক্রবার রাত ২টা থেকে ঝড় শুরু হয়। শনিবার সকাল ৬টার দিকে উপকূলীয় এলাকা অতিক্রম করে ঘূর্ণিঝড় ফণি। শনিবার সকাল থেকে ঝড়ো হাওয়াসহ গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, এর চেয়ে বেশি ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। রোববার ভোর পর্যন্ত ঝড়ো হাওয়া বইবে এবং আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকবে।
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকার এক লাখ ৩১ হাজার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। ফলে ঘুর্নিঝড় ফণী আঘাত হানলেও জেলার কোথাও এখন পর্যন্ত হতাহতের কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। তবে গাছপালা ও বেশ কিছু বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।’
তিনি ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় জেলা প্রশাসন ও পুলিশ, জনপ্রতিনিধি ও সংবাদকর্মিদের সার্বিক সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানান।
যশোর: শনিবার সকাল ১১টার দিকে যশোর অতিক্রম করেছে ঘূর্র্ণিঝড় ফণী। ফনীর প্রভাবে সকাল থেকেই ঝড়ো হাওয়া ও মাঝারি বৃষ্টিপাত হয়। আগে থেকেই মানুষ সতর্ক থাকায় তেমন ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।
যশোর জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দায়িত্বে থাকা জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা নূরুল ইসলাম জানান, ফণীর প্রভাবে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও তাৎক্ষণিকভাবে ফসলের কিছু ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। জেলায় ৮ হাজার ১৫০ হেক্টর জমির ফসলের আংশিক ক্ষতি হয়েছে।
চাঁদপুর: ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে জেলায় শতাধি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। চাঁদপুর সদর উপজেলায় মেঘনার পশ্চিম পাড়ের ১৩ নং হানারচরের দুইটি গ্রামে ২০টি ঘর ও ১৪ নং রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নে তিনটি গ্রামে ৫০টি, হাইমচরের ২টি ইউনিয়নে ১৫ টি, মতলব উত্তর উপজেলার জহিরাবাদ ইউনিয়নে ১০টিসহ তিন উপজেলায় শতাদিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।
ত্রান ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা বি এম জাকির হোসেন জানান, জেলার সদর, হাইমচর ও মতলব উত্তর- এই তিনটি উপজেলায় শতাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
তিনি জানান, দুর্যোগ মোকাবিলায় দুইহাজার প্যাকেট শুকনা খাবার, ৬২৫ মেট্রিক টন চাল ও ৩৮৩ বান্ডিল টিন মজুদ রাখা হয়েছে। শিগগিরই ক্ষতিগ্রস্থদের পূনর্বাসনের কাজ শুরু হবে।
পটুয়াখালী: ঘূর্র্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে জেলার ৮টি উপজেলায় ৬ হাজার ১৮ একর জমির ফসল নষ্ট, ১১ জন আহত,২ হাজার ৯২টি কাঁচা ঘরবাড়ি আশিংক ক্ষতিগ্রস্ত, ১৪৫টি গবাদিপশু নিখোজ ও ১০ কিলোমিটার বেরীবাধ ক্ষতিগ্রস্ত এবং ৫০টি মাছের ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। আজ দুপুরে জেলা প্রশাসক মতিউল ইসলাম চৌধূরী জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে ফণী পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে এ তথ্য জানান।