হবিগঞ্জে ধান কাটার অনুকূল পরিবেশ থাকলেও শ্রমিক সংকট

555

হবিগঞ্জ, ২৮ এপ্রিল, ২০১৯ (বাসস) : ভোরবেলা দুপুরের খাবার সাথে নিয়ে দূরের হাওরে চলে যান তারা। উদ্দেশ্য ধান কাটা। কৃষকের পাকা ধান কেটে দিলে তারা এর একটি অংশ পান। মাস জুড়ে এ কাজ করে যে ধান সংগ্রহ করেন তা দিয়ে তাদের সারা বছরের খাবার চলে। কিছু বিক্রিও করেতে পারেন। হাওর এলাকায় যারা এ কাজ করে তাদেরকে হবিগঞ্জের স্থানীয় ভাষায় ধাওয়াল বলে। এ ধাওয়ালদের উপর নির্ভর করেই বছরের পর বছর হাওরের হাজার হাজার হেক্টর জমিতে ফসল ফলান কৃষক। কিন্ত এবার ধান কাটার অনুকূল পরিবেশ থাকলেও ধাওয়াল সংকটে আছেন কৃষকরা। আবার যেখানে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে তাদেরকে দিতে হচ্ছে উচ্চ মজুরী।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কৃষকদের বিকল্প কর্মসংস্থান এর পাশাপাশি বজ্রপাত আতংকে শ্রমিকরা এখন ধান কাটার কাজ করতে আগ্রহী হন না। ফলে বোরো চাষীরা পড়েছেন চরম শ্রমিক সংকটে। এবারের বোরো মৌসুমে এখনও বজ্রপাতে কোন প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও গত বছর ওই সময়ে হাওরে ২৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন বজ্রপাতে। বজ্রপাতের পাশাপাশি হবিগঞ্জে ব্যাপক শিল্পায়ন হওয়ায় লোকজন চলে যাচ্ছেন সেখানে।পাশাপাশি ধানের দাম কম থাকায় ধান কাটার কাজে শ্রমিকদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
এদিকে গত কয়েক বছরের মাঝে এবারের বোরো মৌসুমে সবচেয়ে অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করছে। বৈশাখ মাস শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত কোন ঝড় বৃষ্টি আসেনি। প্রচন্ড রোদ্র থাকায় সহজেই ধান শুকানোর কাজও করতে পারছেন কৃষকরা। তারপরও শ্রমিক সংকটের জন্য সময়মত ধান ঘরে তুলতে পারছেন না কৃষকরা।
সরজমিনে হবিগঞ্জের বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলার হাওরে গেলে দেখা যায় বিস্তীর্ণ হাওরে সোনালী রং ধারণ করেছে। চারিদিকে শুধু ধান আর ধান। এ দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হবেন যে কেউ। কিন্তু এ সোনালী ধানের মাঝেও কৃষকদের মাঝে বিরাজ করছে দুঃখ আর হতাশা। হাওরে দেখা যায়, ধানের কাজে ব্যস্ত কৃষক-কৃষাণীরা। কেউ ধান শুকাচ্ছেন, মাড়াই করছেন, খড় শুকাচ্ছেন, কেউ আবার ধান সিদ্ধ দিচ্ছেন। যে যার মতো করে যা পারছেন, তাই করছেন। ব্যস্ত সময় পার করছেন নারী-পুরুষ, শিশুরসহ সকলেই।
বানিয়াচং উপজেলার চানপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল মান্নানকে পাওয়া যায় জমি থেকে কেটে আনা ধান মাড়াইয়ে ব্যস্ত। কথা হলে তিনি বলেন,‘এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) ক্ষেতে ধান অয়, বেশি অইলে ১৮ মণ। এ থেকে আরেকবার ধাওয়ালরে (ধান কাটা শ্রমিক) দেলাইতে অয় চাইর (চার) মণ। তার পরে মাড়াই, ধান বাড়িতে নিতে ট্রলি, পানির বিল ও ক্ষেতের চুক্তিতে আরো চইল্লা (চলে) যায় সাত মণ। আর রোয়া থাইক্কা শুরু খইরা (ধান রোপণ থেকে শুরু করে) সব খরচ মিলাইয়া দেখা যায় কিছুই থাকে না। খইতে (বলতে) গেলে এখন গিরস্থী খইরা (কৃষি কাজ করে) কোনো লাভ নাই, লাভের গুড় খাইলায় পিঁপড়ায়’। তার কথায় যেন প্রকাশ পেয়েছে সমগ্র ভাটি বাংলার চিত্র।
একই গ্রামের আমজাদ মিয়া বলেন, ধাওয়াল সংকট এবং ধানের দাম কম হওয়ায় লাভে নেই আমি’। শুধু যে খড়গুলো ঘরে ওঠে, সেগুলো দিয়ে সারা বছরের গো-খাদ্য হয়। এটাই আমাদের লাভ। ধান চাষ করে কি আর হইব।
তিনি আরও বলেন ‘সারাবছর কষ্ট করে ফসল ফলানোর পর ধান কাটা শ্রমিকদের কাছে জিম্মি থাকতে হচ্ছে কৃষককে। এভাবে চলতে থাকলে কৃষকরা ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। কেননা এখনই অনেক কৃষকের আগ্রহ নেই আগের মতো। আগে যারা বেশি জমি চাষ করতেন, তারা প্রায় অর্ধেকের চেয়েও কম জমি চাষ করে এখন। আর ধানের যে মূল্য তা দিয়ে খরচই উঠবে না।
একই এলাকার কৃষক নুর মিয়া বলেন, এ বছর আবহাওয়া ভাল থাকায় ফসল হয়েছে ভাল। তবে ব্রি-২৮ ধান আবাদ করে ক্ষতির শিকার হয়েছেন কৃষক। আগাম এই ফসলে এবার চিটার পরিমাণ বেশী। গভীর হাওরে এ ধান আবাদ হয় বেশি এবং সবার আগে কাটা হয় এ ধান।
হবিগঞ্জের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান বলেন, এ জেলায় সরকারি হিসেব মতে ৩০ শতাংশ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। তবে হাওর এলাকায় তা ৭০ শতাংশ। হবিগঞ্জ-বানিয়াচং আঞ্চলিক মহাসড়কে ধান শুকানো হচ্ছে। এর মধ্যে বৃ-ধান-২৮ এবং হাইব্রিড জাতের ধান বেশি কাটা হয়েছে। কোন ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগেই ধান কাটা সম্পন্ন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। শ্রমিক সংকটের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছরই শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। তবে এবার একটু বেশি’।
তিনি আরও জানান, জেলায় এবার বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ১১৫ হেক্টর। চাষ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ১ লাখ ২১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আলী জানান, বোরো ধান আবাদে যে খরচের হিসাব করা হয় এর মাঝে সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন ভর্তুকি হিসাবে আসে না। কৃষকদেরকে ডিজেলে ভর্তুকী, বিনামূল্যে সার ও বীজও সরবরাহ করা হয়। কৃষি বিভাগ শ্রমিক সংকট মোকাবেলায় সারা জেলায় প্রতি বছর কৃষকদের মাঝে ৭০% ভর্তুকী মূল্যে রিপার বিতরণ করছে। এক সময় কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে এ সমস্যার মোকাবেলা করার প্রচেষ্টা আছে সরকারের।
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী এমএল সৈকত জানান, হাওরে মাঠভর্তি পাকা ধান থাকলেও শ্রমিক এর কারণে কৃষকরা ঘরে ধান তুলতে পারছেন না। তাই পানি উন্নয়ন বোর্ডও কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে রিপার বিতরণ করছে। মূলত বিকল্প কর্মসংস্থান এবং বজ্রপাতের ভয়ে ধানকাটতে আগ্রহ হারাচ্ছেন শ্রমিকরা।
হবিগঞ্জের জেলা খাদ্য কর্মকর্তা আব্দুস সালাম বলেন, শীঘ্রই সরকারীভাবে ধান চাউল ক্রয় কার্যক্রম শুরু হবে। এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় কৃষকরা চাইলে এখনই ধান বিক্রি না করে তা সুন্দরভাবে সংগ্রহ করে পরে বিক্রি করতে পারেন। এতে কৃষকরা লাভবান হবেন। অন্যান্য মৌসুমে বৃষ্টির জন্য অনেক কৃষক কাচা এবং ভিজা ধান বিক্রি করে লোকসান গুণতেন।